আবারও বরফ যুগে ফিরবে পৃথিবী
পৃথিবীর জলবায়ু সবসময় পরিবর্তনশীল। তাপমাত্রা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। এখন উষ্ণ হয়ে উঠেছে এই গ্রহ। তবে আজ থেকে ১১ হাজার বছর পর পৃথিবী আবার বরফ যুগে ফিরে যাবে বলে এক গবেষণায়ে উঠে এসেছে।
পৃথিবীর বরফ যুগের কারণ নির্ধারণ সবসময় কঠিন। অনেকদিন ধরেই গবেষকরা অনুমান করছিলেন, সূর্য ঘিরে পৃথিবীর বিচিত্র কক্ষপথ তুষার যুগের আগমন বা অবসানের কারণ হতে পারে।
নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীর কক্ষপথের এমন কিছু পরিবর্তনের মধ্যে একটি স্পষ্ট সম্পর্ক রয়েছে। এটি বরফ যুগের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে এখন ভবিষ্যতে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনগুলো পূর্বাভাস দেওয়ার একটি নতুন উপায় জানা গেছে।
আর মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে পৃথিবী ধ্বংস না হলে ১১ বছর পর আবার বরফ যুগ আসবে। পৃথিবীর সূর্যের চারপাশে কক্ষপথ পুরোপুরি গোলাকার নয়। এটি কিছুটা ডিম্বাকৃতির, যা ‘কক্ষপথের বৈকল্পিকতা’ নামে পরিচিত। এ কারণে সূর্যটি ঠিক কেন্দ্রে না থেকে কিছুটা স্থানচ্যুত থাকে। ফলে সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব বছরজুড়ে পরিবর্তিত হয়।
পৃথিবীর কক্ষপথের আকার এবং অবস্থান সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। এ পরিবর্তনটি প্রতি ২৬ বছরে একবার ঘটে এবং পৃথিবীর কক্ষপথের অক্ষের দিক পরিবর্তন করে। একে ‘কক্ষপথের প্রিসেশন’ বলে।
আর পৃথিবীর ঘূর্ণন অক্ষের ঢাল ‘অব্লিকুইটি’ নামে পরিচিত। অর্থাৎ পৃথিবী তার কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে যে কোণে ঘোরে। পৃথিবীর অক্ষীয় ঢাল প্রায় ২৩ দশমিক ৫ ডিগ্রি, যা পৃথিবীকে তার কক্ষপথের তুলনায় একটু বেঁকে থাকতে বাধ্য করে। সূর্য কেন্দ্র করে পৃথিবী যেভাবে ঘোরে, তার সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবর্তিত হয়।
সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্কের এ বিভিন্ন গুণাবলি তাপমাত্রার উষ্ণ ও শীতল চক্র সৃষ্টি করে। পৃথিবীর কক্ষপথের বিভিন্ন পরিবর্তন সূর্যের আলো কীভাবে পৃথিবীতে ছড়ায়, তাতে প্রভাব ফেলে। তবে, পৃথিবীর কক্ষপথের কোন কোন দিক এই জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে, তা বের করা কঠিন।
যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির পৃথিবী বিজ্ঞানী স্টিফেন বার্কার বলেন, পৃথিবীর জলবায়ু একটি জটিল-আন্তঃসংযোগ ব্যবস্থা, যেখানে নানা প্রক্রিয়া একসঙ্গে কাজ করে পরিবর্তনগুলো তৈরি করে।
বরফ যুগের চক্রের সময়সীমার মধ্যে এ পরিবর্তনগুলোর মডেল তৈরি করতে প্রচুর শক্তিশালী কম্পিউটিং শক্তির প্রয়োজন। কারণ এ প্রক্রিয়াগুলো একে অপর থেকে পৃথকভাবে মাপা এবং এর মডেল তৈরি করা খুব কঠিন কাজ।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পৃথিবীর কক্ষপথের প্রিসেশন চক্র ২১ হাজার বছরে এবং অব্লিকুইটির দ্বিতীয় চক্র ২০ হাজার ৫০০ বছরে ঘটে। তবে, এই দুই চক্রের মধ্যে কোনো সম্পর্ক বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি। বিজ্ঞানী বার্কারদের নতুন গবেষণাটি ‘সায়েন্স’ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
আরেকটি বিষয় হলো, আট লাখ বছরে বরফ যুগের অবসান প্রতি এক লাখ বছরে ঘটছে। এর কারণ বিজ্ঞানীরা পাননি। বার্কার এবং তার সহকর্মীরা গত আট লাখ বছরের মধ্যে গভীর সাগরের অক্সিজেন আইসোটোপের অনুপাত পরিবর্তন বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন। এ তথ্য মাইক্রোস্কোপিক সামুদ্রিক প্রাণী ফরামিনিফেরারের ফসিলে সংরক্ষিত।
এ পরিবর্তনগুলো মহাদেশীয় বরফের স্তরের বা বরফ শিটের পরিমাণের পরিবর্তন শনাক্ত করতে ব্যবহৃত হয়। এটি পৃথিবীর অতীত বরফ যুগের সম্পর্কে জানার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক।
এ তথ্য ব্যবহার করে বরফ যুগের চক্রের একটি বিস্তারিত গ্রাফ তৈরি করেন গবেষকরা, যেখানে তারা পৃথিবীর কক্ষপথের দুটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য—প্রিসেশন এবং অব্লিকুইটির সঙ্গে তুলনা করেন।
আর তখনই একটি চমকপ্রদ প্যাটার্ন উন্মোচিত হয়। গ্লেসিয়াল এবং ইন্টারগ্লেসিয়াল (বরফ যুগ এবং উষ্ণ সময়ে) পর্বের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়গুলো প্রিসেশন এবং অব্লিকুইটির মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কের সঙ্গে মিলে যায়। এভাবে বরফ যুগের এক লাখ বছরের চক্রের প্রমাণ পান গবেষকরা।
বিজ্ঞানী বার্কারের মতে, বরফ যুগের সূচনাগুলোর সময়কাল অনেকটাই এলোমেলো বলে আগের গবেষণায় দাবি করা হয়। তবে তার গবেষণা বলছে, এটি নির্ধারিত।
অর্থাৎ এখন আমাদের কাছে এমন একটি টুল রয়েছে, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে কখন তুষার যুগ শুরু হবে, তা পূর্বাভাস দিতে পারি। পৃথিবীর অব্লিকুইটি বর্তমানে কমতে শুরু করেছে এবং এটি ১১ হাজার বছরের মধ্যে তার ন্যূনতম পর্যায়ে পৌঁছাবে এর আগেই পরবর্তী বরফ যুগ শুরু হবে।