কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে শীর্ষে চীন
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাসে সোচ্চার বিশ্ব। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি অনুসারে বিভিন্ন ফোরামে নেয়া হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা।
ফলে বিশ্বব্যাপী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধে সচেতনতা বেড়েছে, বিপরীতে বাড়ছে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার। তবে বৈশ্বিক এজেন্ডার প্রতি সংহতি জানালেও চীনা পদক্ষেপে এর সঙ্গে সংগতি কমই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কারণ হিসেবে গবেষকরা জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে চীনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে। এটি দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ২০৩০ সালের আগে কার্বন নিঃসরণের শীর্ষে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (ক্রেয়া) এবং গ্লোবাল এনার্জি মনিটর (জেইএম) গতকাল এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
সেখানে বলা হচ্ছে, ২০২৪ সালে চীন রেকর্ড ৩৫৬ গিগাওয়াট (জিডব্লিউ) বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা যোগ করেছে। একই সঙ্গে ৯৪ দশমিক ৫ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেছে, যা ২০১৫ সালের পর সর্বোচ্চ।
নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি আগে স্থগিত হওয়া ৩ দশমিক ৩ গিগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা প্রকল্প পুনরায় চালু করেছে চীন। এতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় জীবাশ্ম পণ্যটির গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এ পরিস্থিতি নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে দেশটির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতিকে সমালোচনার মুখে ফেলে দিয়েছে।
হেলসিংকিভিত্তিক ক্রেয়ার চীনবিষয়ক বিশ্লেষক কি কিন ও ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক জেইএমের ক্রিস্টিন শিয়ারার নেতৃত্বে প্রতিবেদনটি তৈরি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিকল্প হিসেবে ক্লিন বা পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের পরিবর্তে স্থায়ীভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা বাড়ছে চীনে।
এ কারণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি উপরিতলের পদক্ষেপ হিসেবে থেকে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে কয়লা ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সমান্তরাল সম্প্রসারণ চীনের পরিবেশবান্ধব জ্বালানির রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণকারী চীন। এশিয়ার এ দেশ থেকে বিশ্বব্যাপী মোট নিঃসরণের প্রায় ৩০ শতাংশ আসে। তবে চীন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
গত বছর বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার সম্প্রসারণ যুক্তরাষ্ট্রের মোট ইনস্টল ক্ষমতার সমান ছিল। শি জিনপিং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যে চীন ২০৩০ সালের আগে কার্বন নিঃসরণের শীর্ষে পৌঁছবে এবং ২০৬০ সালের মধ্যে নিট শূন্য নিঃসরণে পৌঁছবে।
একজন ঊর্ধ্বতন চীনা কর্মকর্তা বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় চীন সবসময়ই বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেয়া দেশ এবং পরিবেশবান্ধব ও নিম্ন কার্বন নিঃসরণ করে এমন উন্নয়নের প্রতি আমরা দৃঢ়ভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমাদের কার্বন নিঃসরণের তীব্রতা ক্রমাগত কমছে, মোট জ্বালানি ব্যবহারের মধ্যে জীবাশ্ম নির্ভর নয় এমন জ্বালানির অংশ স্থিরভাবে বাড়ছে।’
তবে ক্রেয়া ও জিইএমের প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, চীনের বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে কাঠামোগত কিছু সমস্যা রয়েছে। এ কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তরকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনে ক্রেতারা দীর্ঘমেয়াদি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে আবদ্ধ, এতে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিদ্যুৎ না কিনলে তাদের জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। বিষয়টি বিদ্যুৎ ক্রেতাদের পরিবেশবান্ধব জ্বালানিকে অগ্রাধিকার দেয়ার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করে।
এছাড়া কয়লা খনি কোম্পানিগুলো নতুনভাবে অনুমোদিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ৭৫ শতাংশে অর্থায়ন করছে। এতে বাজারের বাস্তবতা বা চাহিদা বিবেচনা না করেই নতুন প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে কয়লাবিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর ভবিষ্যৎ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, চীনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় কয়লা ও পরিবেশবান্ধব জ্বালানির প্রতিযোগিতা ক্রমে বাড়ছে। ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বিদ্যুতের চাহিদার বৃদ্ধি ধীরগতির হলেও জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন উচ্চ স্তরে বজায় ছিল। অথচ সৌর ও বায়ুশক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল।
বিশ্লেষকরা আরো বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও নবায়নযোগ্য শক্তির অর্থনৈতিক কাঠামো ভিন্ন। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে প্রায়ই বিদ্যুৎ গ্রিডে ব্যাকআপ হিসেবে প্রস্তুত থাকার জন্য ‘ক্যাপাসিটি পেমেন্ট’ দিতে হয়।
পরামর্শক সংস্থা লানটাউ গ্রুপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক ডেভিড ফিশম্যানের মতে, সাধারণত কয়লার সঙ্গে কয়লার প্রতিযোগিতা হয়। তিনি আরো জানান, চীনের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর গড় ব্যবহারের হার প্রায় ৫০ শতাংশ। নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে সামগ্রিকভাবে এসব অবকাঠামো ব্যবহারের হার আরো কমে যেতে পারে।