খরায় গাছের মৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা: উষ্ণতায় ভারী হবে পৃথিবী
প্রকৃতির নীরব এক যোদ্ধা হলো গাছ। এরা ছায়া দেয়, বৃষ্টিকে ডেকে আনে, মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখে আর আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন উপহার দেয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান খরা সেই নিঃশব্দ যোদ্ধাদের শক্তি ক্ষয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। বৈশ্বিক এক দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা বলছে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে খরার প্রভাবে গাছের মৃত্যু বাড়বে, যা পৃথিবীর উষ্ণতা ও পরিবেশের ভারসাম্যে গভীর প্রভাব ফেলবে।
নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার জুইডেমা ও ব্রাজিলের ইউনিভার্সিটি অব ক্যাম্পিনাসের অধ্যাপক পিটার গ্রোয়েনেন্ডি এই গবেষণার নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক মিজানুর রহমান, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার অধ্যাপক ভেলেরি ট্রাউট ও ফ্লোরিন বাবস্টসহ আরও অনেকে। ৩১ জুলাই ২০২৫ তারিখে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী Science-এ প্রকাশিত হয়েছে এই গবেষণা, যার শিরোনাম “উষ্ণমণ্ডলীয় গাছের কাণ্ডের বৃদ্ধিতে খরার প্রভাব সামান্য”।
গবেষণার জন্য প্রায় একশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ১৯৩০ সাল থেকে ২০২০-এর দশক পর্যন্ত ৩৬টি দেশের ৫০০টি স্থানের ২০ হাজারেরও বেশি গাছের বর্ষবলয় পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। খরার সবচেয়ে প্রকট বছরগুলো বেছে নিয়ে দেখা হয়েছে, সেই সময় গাছের বৃদ্ধি কতটা কমে গিয়েছিল এবং খরার পরবর্তী দুই বছরে গাছ কতটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। গাছের বর্ষবলয় যেন প্রকৃতির এক নিঃশব্দ দিনলিপি, যেখানে প্রতিটি বৃত্তে লেখা থাকে সেই বছরের জলবায়ুর গল্প।
বিশ্বের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে দেখা গেছে, খরার বছরে গাছের বৃদ্ধি গড়ে ২.৫ শতাংশ কমে যায়। অধিকাংশ গাছ পরের বছর আগের গতি ফিরে পায়। তবে বাংলাদেশে পরিস্থিতি অনেক কঠিন। অধ্যাপক মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, খরার বছরে বাংলাদেশে গাছের বৃদ্ধি প্রায় অর্ধেক কমে যেতে পারে। ১৯৯৯ সালের ভয়াবহ খরায় রেমা-কালেঙ্গা বনের চিক্রাশিগাছের বৃদ্ধি আগের বছরের তুলনায় ৫৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, খরার প্রভাবে বছরে অতিরিক্ত প্রায় ০.১ শতাংশ গাছ মারা যেতে পারে। এই সংখ্যা ছোট মনে হলেও এর প্রভাব বিরাট। গাছ কমে গেলে তারা যে পরিমাণ কার্বন শোষণ করত, তা বাতাসে থেকে যাবে, আর গাছ মারা গেলে ও পচে গেলে অতিরিক্ত কার্বন বাতাসে মিশে যাবে। এর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়বে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ আরও জটিল হবে।
এখনো পর্যন্ত দেখা যায়, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন খরার পরও তুলনামূলক দ্রুত পুনরুদ্ধার করতে পারে। কিন্তু যদি জলবায়ু পরিবর্তনের গতি থামানো না যায়, খরার মাত্রা ও ঘনত্ব দুটোই বাড়বে এবং তখন এই পুনরুদ্ধারক্ষমতা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। অধ্যাপক মিজানুর রহমানের মতে, প্রকৃতি নিজেকে সামলে নিতে পারে, কিন্তু যদি আমরা তাকে অবিরত চাপ দিই, একসময় সে আর পেরে উঠবে না।
গাছ কেবল সবুজ ছায়া নয়, বরং পৃথিবীর শ্বাস-প্রশ্বাসের কেন্দ্র। তাদের রক্ষা করা মানে আমাদের ভবিষ্যতকে রক্ষা করা। খরা, জলবায়ু পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট চাপের এই যুগে গাছ রক্ষা করা যেন প্রকৃতির প্রতি এক অনিবার্য অঙ্গীকার।