খুলনায় ইটভাটার ফলে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ
আইন অনুযায়ী, আবাসিক, সংরক্ষিত বা বাণিজ্যিক এলাকা, পৌরসভা বা উপজেলা সদর, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সংলগ্ন এলাকা, কৃষি জমি এলাকায় স্থাপন করা যাবে না ইটভাটা। কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। জেলা ও বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ ইটভাটারই নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র। পুরো খুলনা জেলায় ১০১টি ইটভাটার মধ্যে ৪৫টিরই নেই পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এসব ইটভাটার মধ্যে নদীর তীর দখল করে আছে অন্তত ৫০টি। আর বিভাগ জুড়ে এই তথ্য আরও ভয়ংকর, বিভাগের ১০ জেলায় গড়ে ওঠা এক হাজার আটানব্বইটি ভাটার মধ্যে ৭৯০টিরই নেই পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদন।
অভিযোগ আছে, আধিপত্যের মাধ্যমে প্রভাবশালীরা নদীর তীর ও খাসজমি দখলসহ ঘনবসতি এলাকা এমনকি হাসপাতাল- স্কুলের পাশের স্থানেই গড়ে তুলেছে এসব ইটভাটা। ফলে খুলনা অঞ্চলের বাতাসে বাড়ছে দূষণ। স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ছে এই অঞ্চলের মানুষের। সংকুচিত হচ্ছে নদী।
ডুমুরিয়া উপজেলার খর্নিয়া ইউনিয়িনের কৃষক করিম বলেন, ‘ইটভাটার জন্য প্রতি বছরই আমরা কৃষি ফসল ফলাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এখন আমের মুকুল আসার সময়। ইটভাটার ধোঁয়ার কারণে আমের মুকুল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেক স্থানে আরও অনেক ফসল উৎপাদন কমে আসে এসব ইটভাটার কারণে। আমরা এসব ইট ভাটা বন্ধ চাই না।’
একই এলাকার আরেক কৃষক পলাশ দাস বলেন, ‘আমাদের এই এলাকাটি এক সময় কৃষি ফসলের জন্য বিখ্যাত ছিল। তবে প্রতি বছরই আমাদের উৎপাদন কমে আসছে। এমনভাবে কমতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ উৎপাদন নিয়ে আমরা শঙ্কায় আছি।’
ডুমুরিয়া সদর উপজেলার স্কুল শিক্ষক আলী হোসেন বলেন, ‘আমাদের এই এলাকার শিশু এবং বয়স্করা অনেক বেশি শ্বাসকষ্টে ভোগেন। আমরা বারবার বলে আসছি এটি বন্ধের জন্য। কিন্তু সেভাবে কার্যকর হচ্ছে না।’
খোদ পরিবেশ অধিদফতরের তথ্য বলছে, ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতি ঘনমিটারে খুলনার বাতাসে ধূলিকণার মাত্রা ছিল ২৫৯, ২৭৪ ও ৪২০ মাইক্রোগ্রাম। যা চরম অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত। আর এই দূষণের অন্যতম কারণ হল এসব ইটভাটার কয়লা পোড়ানো ধোঁয়া। পরিবেশবাদী সংগঠন বলছে, দূষণ রোধে কঠোর হতে হবে সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোকে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার জাতীয় পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, ‘অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আমরা বছরের পর বছর আন্দোলন করে আসছি। তবে আমাদের সে আন্দোলন খুব একটা কাজে আসে না। সম্প্রতি সরকার ইটভাটা বন্ধে কঠোর হয়েছে। আমরা এটাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে যারা এটা বাস্তবায়ন করবে, তারা সেভাবে করছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা লোক দেখানো কিছু অভিযান পরিচালনা করে, হয়তো কিছু জরিমানা করে, কিন্তু আবারও চালু হয়ে যায়। পরিবেশ অধিদফতরের লোকবল, গাড়ি বা অন্য কিছুর যদি কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে সরকারের সেটা দ্রুত দূর করা উচিৎ।’
আর ইটভাটায় বিনিয়োগকারীরা পরিবেশ বান্ধব রূপান্তরে চাইছে সময় ও রাষ্ট্রীয় আর্থিক সুবিধা। মেসার্স স্টোন ব্রিকসের স্বত্বাধিকারী ইকবাল জোয়ার্দ্দার বলেন, ‘আমরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছি এসব ইটভাটায়। আমরা যখন শুরু করেছি তখন পরিবেশ অধিদফতর আমাদের ছাড়পত্র দিয়েছিল। এখন যদি বলে আর ছাড়পত্র দেব না, তাহলে তো আমরা আর্থিকভাবে অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবো। আমাদের একটা নির্ধারিত সময় দেয়া উচিৎ যাতে আমরা বিনিয়োগ করা অর্থ ফেরত পেতে পারি। আর ব্লক আকারে ইটভাটা তৈরির জন্য আমাদের সরকারি আর্থিক সহায়তা দিলে আমাদের কাজটা সহজ হবে।’
যদিও পরিবেশ অধিদফতর বলছে, জোরদার করা হচ্ছে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযান।
পরিবেশ অধিদফতর খুলনার সহকারী পরিচালক পারভেজ আহম্মেদ বলেন, সরকার অবৈধ ইটভাটার ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর। আমরাও জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে এ বিষয়ে খুবই কঠোর। যারাই অবৈধভাবে ইটভাটা চালাচ্ছে সবগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। নতুন করে কোন ইটভাটার প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হবে না পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র।
গত দুই মাসে বিভাগের বিভিন্ন জেলায় ৪৪টি অবৈধ ইটভাটা ভেঙে দিয়েছে পরিবেশ অধিদফতর।