জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিত বাংলাদেশ
বাংলাদেশ একটি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অতিরিক্ত বর্ষণ, ঘূর্ণিঝড়, জলাবদ্ধতা, ভূমিধস ও লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। এই পরিবর্তনগুলোর ফলস্বরূপ, দেশের বৃহত্তর জনগণ বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি এলাকা এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসরত জনগণের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। তবে জলবায়ু সংকটের প্রভাব মোকাবিলায় সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
সুশাসনের অভাব, বৈষম্যপূর্ণ নীতিমালা এবং সঠিক পদক্ষেপের অভাব জলবায়ু সংকটকে আরো ভয়াবহ করে তুলছে, যা বাংলাদেশের জনগণের নাজুকতাকে আরো ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি করছে।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি মূলত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙন এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সাথে সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা দেখে নিতে পারি।
২০২৪ সালে ফেনী জেলায় ভয়াবহ বন্যার কারণে বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বসতবাড়ি খাতে প্রায় ৭০ হাজার ৪১৫টি আধপাকা ও কাঁচা ঘর, আসবাবপত্র এবং বৈদ্যুতিক সামগ্রী পানিতে তলিয়ে গিয়ে আনুমানিক ৫৩৩ কোটি ৫৯ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া, প্রায় ৬৭ হাজার ২৮৭টি কাঁচা-পাকা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সড়ক ও অবকাঠামো খাতে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এবং সড়ক বিভাগের আওতাধীন সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্টে প্রায় ১৪০ কোটি ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলার ৫৩৯টি সড়ক এবং ৬২টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মোট আর্থিক ক্ষতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫৮৮ কোটি টাকা।
কৃষি, মৎস্য এবং প্রাণিসম্পদ খাতে এই বন্যায় প্রায় ৯১৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সম্পূর্ণ ক্ষতির পরিমাণ ১৬ হাজার ৫৮ কোটি ৮২ লাখ ১৫ হাজার ৪১৫ টাকা এবং আংশিক ক্ষতি ১৪ হাজার ৪৯ কোটি ৩১ লাখ ৯৪ হাজার ৮৫৯ টাকা, যা মোট প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সমান। বন্যার কারণে ফেনী জেলার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যা স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রায় গভীর প্রভাব ফেলেছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ জমি বন্যায় প্লাবিত হয়। ১৯৭০-২০০০ সাল পর্যন্ত ৩৪টি বড় বন্যার মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ জমি প্লাবিত হয়েছিল।
পাশাপাশি, ১৯৭০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে উপকূলে প্রায় ৫০টিরও বেশি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল এবং হাজার হাজার বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ২০০৭ সালের সিডর এবং ২০০৯ সালের আইলা ঘূর্ণিঝড়েও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।
নদী ভাঙনও বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। প্রতি বছর নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে বাড়িঘর, কৃষিজমি এবং রাস্তা-ঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চলের নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতি বছর প্রায় ৩.৩ মিলিমিটার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আরো গুরুতর প্রভাব ফেলছে। এর ফলে প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছেন।
বৃষ্টিপাতের ধরনেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী শুষ্ক মৌসুম এবং অনিয়মিত বর্ষণের কারণে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। ২০০৯ সালে বৃষ্টির অনিয়মিত প্যাটার্নের কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যেও সমস্যা বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গরম-জনিত অসুস্থতা, ডায়রিয়া, টাইফয়েডের মতো রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু রোগের বিস্তারও বেড়েছে।