জাতীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত রাব্বীর তৎপরতায় বেঁচে গেল ৪৯টি পদ্মগোখরা
বিশ্ব পরিবেশ দিবস ও পরিবেশ মেলা উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে নাটোরের পরিবেশকর্মী ফজলে রাব্বীকে জাতীয় পুরস্কার প্রদান করেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এই সম্মান অর্জনের পেছনে রয়েছে একাধিক ব্যতিক্রমধর্মী ও সাহসিকতাপূর্ণ কর্মকাণ্ড, যার মধ্যে একটি বিশেষ ঘটনা আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে।
২০২০ সালের ১২ আগস্ট, নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার একটি গ্রামে ঘটে যায় এক বিরল ও ভয়াবহ ঘটনা। শাহাদত হোসেন নামে এক ব্যক্তি অবৈধভাবে তাঁর বাড়িতে ৪৯টি বিষধর পদ্মগোখরা সাপ আটকে রেখেছিলেন। প্রশিক্ষণ না থাকায়, এ ধরনের বিপজ্জনক সাপ নিয়ে বসবাস গ্রামবাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্কের জন্ম দেয়। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে প্রতিক্রিয়া জানান ফজলে রাব্বী। তিনি যোগাযোগ করেন বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সঙ্গে। বিভাগের কর্মকর্তারা এসে সাপগুলো উদ্ধার করে নির্দিষ্ট সংরক্ষিত এলাকায় ছেড়ে দেন, যার ফলে মুক্ত হয় গ্রামবাসী।
এই একটি ঘটনাই তাঁর কাজের পূর্ণতা নয়। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি নিঃস্বার্থভাবে রক্ষা করে চলেছেন প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীদের। তাঁর তৎপরতায় এখন পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে নয় হাজারের বেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি, পঁচাশি প্রজাতির সাপ, পাঁচটি হনুমান, একটি শকুন, পাঁচটি বেজি, একটি মেছো বিড়াল, আঠারোটি বনবিড়াল, একটি নেপালি ঈগল, পাঁচটি দেশি ঈগল, আটাশটি কাছিম ও দুটি ময়ূর। পাশাপাশি বন্য প্রাণী শিকারিদের ব্যবহৃত তিন শতাধিক ফাঁদ ও জাল তিনি নিজের উদ্যোগেই ধ্বংস করেছেন।
শুধু প্রাণী উদ্ধার নয়, পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা তৈরিতেও তিনি ছিলেন সমান দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিনি এখন পর্যন্ত রোপণ করেছেন ৩০ হাজার গাছ, বিতরণ করেছেন এক লাখ ৩০ হাজার সচেতনতামূলক লিফলেট এবং ১৮০ বার মাইকিং করে জনসাধারণকে বন্য প্রাণী রক্ষার আহ্বান জানিয়েছেন।
৩২ বছর বয়সী এই তরুণের জন্ম নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগর হাজীপাড়া গ্রামে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি প্রকৃতির প্রতি ভালবাসা পোষণ করেন এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা রূপ নেয় দায়বদ্ধতায়। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ফেডারেশনের (বিবিসিএফ) প্রচার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০২৫ সালের জাতীয় বন্য প্রাণী সংরক্ষণ পুরস্কার গত ২৫ জুন,২০২৫, তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পুরস্কার গ্রহণের পর তিনি বলেন, “নলডাঙ্গা পুরোপুরি বন্য প্রাণীর জন্য নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত আমার কাজ চলবে।” এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তিনি গড়ে তুলেছেন ‘সবুজ বাংলা’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সেখানে গ্রামের শিশুসহ নানা বয়সী নারী-পুরুষ সক্রিয়ভাবে যুক্ত আছেন। হালতি বিল বা আশপাশের কোনো এলাকায় বন্য প্রাণী বিপদে পড়লেই খবর যায় রাব্বীর কাছে, আর তিনি ছুটে যান সাড়া দিতে।
সম্প্রতি নলডাঙ্গার বাঁশভাগ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তার দু’ধারে সারি সারি বকুল গাছ, আর পাশের দাখিল মাদ্রাসার আঙিনায় আম ও কাঁঠালের ছায়া। স্থানীয়রা জানান, এগুলো রোপণ করেছিলেন রাব্বী প্রায় এক যুগ আগে। এখন সেসব গাছে ফুল ধরেছে, ফল ধরেছে—পাখিরা সেখানে খুঁজে পাচ্ছে খাদ্য ও আশ্রয়।
সবুজ বাংলার বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক হুমাউন রশিদ জানান, রাব্বীর দেখে গ্রামের অনেকেই গাছ লাগাতে উৎসাহিত হয়েছেন। অন্যদিকে, রাজশাহী বিভাগে দায়িত্ব পালনকালে পরিবেশ রক্ষায় তরুণদের নিয়ে ছোট ছোট সংগঠন গড়ে তোলেন বিবিসিএফের প্রতিষ্ঠাতা ও বন সংরক্ষক মোল্যা রেজাউল করিম। তাঁর মতে, রাব্বীর মতো সংগঠকদের কারণেই আজও অনেক বন্য প্রাণী টিকে আছে। তারা কোনো সরকারি সহায়তা ছাড়াই নিজেদের সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে কাজ করে চলেছেন। একটি জাতীয় পুরস্কার তাঁদের এই নিরলস প্রচেষ্টার বড় প্রাপ্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণা।
ফজলে রাব্বীর গল্প কেবল একটি গ্রামের নয়, এটি একটি আন্দোলনের প্রতীক—যেখানে একজন মানুষের দায়বদ্ধতা বদলে দিতে পারে প্রকৃতির ভবিষ্যৎ।