জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে নিম
জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয়ের ঝুঁকির শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। ভয়াবহ বায়ুদূষণের কবলে দেশের মানুষ। অব্যাহত বাড়ছে তাপমাত্রা। নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর। দেশের অনেক এলাকায় শুরু হয়েছে মরুকরণ প্রক্রিয়া। জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষিতে বাড়ছে পোকামাকড়ের আক্রমণ।
রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দূষিত করছে মাটি, পানি। এতে হুমকিতে পড়েছে জীববৈচিত্র্য। হারিয়ে গেছে অনেক প্রাণিসত্তা। তথ্য বলছে, এসব সমস্যার অধিকাংশ থেকেই মুক্তি দিতে পারে নিম গাছ। জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে ফিরিয়ে আনতে পারে পরিবেশের ভারসাম্য।
বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, নিমের ঔষধি গুণাগুণ ছাড়াও এটি বায়ু পরিশোধন, মাটি সংরক্ষণ, পানি ধারণ, তাপমাত্রা হ্রাস এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অনন্য ভূমিকা পালন করে। নিম গাছের পাতা ও কাঠের তন্তু বায়ু থেকে কার্বন-ডাইঅক্সাইড, সালফার-ডাইঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান শোষণ করতে পারে।
জার্নাল অব ফরেস্ট্রি-২০১৯ এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, এক হেক্টর জমির নিম গাছ বছরে ১০-১২ টন কার্বন-ডাইঅক্সাইড শোষণ করতে পারে, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
নিমের গুণাবলির প্রমাণ মিলেছে মরুর দেশ সৌদি আরবে। মরুপ্রধান দেশটিতে উচ্চ তাপমাত্রায় সবুজায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভূমিকা রাখছে নিম। মরুর বুকে এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে লাখ লাখ নিম গাছ। ইতোমধ্যে মরুকরণ, বায়ুদূষণ ও বালুঝড় প্রতিরোধে সফলতার সাক্ষর রেখেছে গাছটি।
মরুর দেশ হলেও সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দায় বায়ুর মান সহনশীল পর্যায়ে থাকছে সব সময়। সৌদি ন্যাশনাল সেন্টার ফর ভেজিটেশন কভারের গবেষণায় দেখা গেছে, নিম গাছ বালুঝড় ও মাটি ক্ষয় কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে, যা মরুকরণ রোধ করে।
কিং আবদুল আজিজ সিটি ফর সায়েন্ট অ্যান্ড টেকনোলজির তথ্যানুযায়ী, নিম গাছ ৫০ ডিগ্রি সে. পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে। সৌদি ভিশন-২০৩০ ও সৌদি গ্রিন ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের অধীনে মরুকরণ রোধ, বায়ু বিশুদ্ধকরণ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য ব্যাপকভাবে নিম গাছ লাগানো হচ্ছে।
জানা গেছে, ১৯৭০-এর দশকে সৌদি আরবে- বিশেষ করে রিয়াদ ও জেদ্দায় পরীক্ষামূলকভাবে নিম গাছ লাগানো হয়। দ্রুত বর্ধনশীলতা, খরাপ্রতিরোধী ক্ষমতা, কম পানির চাহিদা ও তাপমাত্রা কমাতে ভূমিকার কারণে ১৯৯০-এর দশকে সৌদি সরকার ও বন বিভাগ শহর ও মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে নিম গাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়।
সফলতা আসায় পরবর্তীতে গ্রিন রিয়াদ প্রকল্পে নিম গাছ প্রধান বৃক্ষ হিসেবে সংযোজিত হয়। ২০০৭ সালে সৌদি পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো দেশজুড়ে নিম গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেয়।
সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ২০২১ সালে ১০ বিলিয়ন গাছ রোপণের পরিকল্পনা নিয়ে ‘সৌদি গ্রিন ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প ঘোষণা করেন, যেখানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গাছ হিসেবে নিমকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মিডল ইস্ট গ্রিন ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের অধীনে সৌদি ছাড়াও আশপাশের দেশগুলোতে নিম গাছ লাগানো হচ্ছে।
সৌদিপ্রবাসী মামুন মুন্সী বলেন, রিয়াদ ও জেদ্দায় এখন বড় বড় নিম গাছে ভরে গেছে। তবে নিম গাছকে এখানে অনেকে জিয়া গাছ বলে ডাকেন।
শুনেছি জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সৌদি রাজপরিবারকে নিম গাছ উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন এবং আরাফাত ময়দানে তিনি নিজে নিম গাছ লাগিয়েছিলেন। এ কারণেই এই নামকরণ।
বায়ুদূষণ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নিম গাছ। ভারতের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, নিম গাছের পাতা বায়ু থেকে দূষক উপাদান পিএম ২.৫ ও পিএম ১০ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় শোষণ করতে সক্ষম।
নিম গাছ শিল্প এলাকায় ও শহুরে দূষণ দূর করতে সবচেয়ে উপযুক্ত প্রজাতিগুলোর মধ্যে একটি এবং অধিক দূষিত এলাকায় এটি সবুজ বেল্টের মতো কাজ কর। এ ছাড়া নিমপাতায় থাকা প্রাকৃতিক ফাইটোকেমিক্যালস ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ধ্বংস করে বায়ু বিশুদ্ধ রাখে।
২০১৮ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচার রিসার্চ (আইসিএআর) পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, নিম গাছের উপস্থিতি ভূমির পানি ধারণক্ষমতা প্রায় ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে পারে। নিম গাছের ছায়ায় তাপমাত্রা ৩-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত কম থাকে, যা গ্রীষ্মে পশুপাখির জন্য উপকারী।
নিমের পাতা ও বীজে থাকা আজাডিরাচটিন নামক উপাদান পোকামাকড় দূর করতে সাহায্য করে, যা পরিবেশবান্ধব কিটনাশক হিসেবে কৃষিতে ব্যবহৃত হয়। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স-২০২০ এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিম গাছ মৌমাছির বাসস্থান রক্ষা করতে সাহায্য করে এবং পরাগায়নে ভূমিকা রাখে।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাবেদ হোসেন বলেন, ভূমিক্ষয় রোধ, মাটির পানি ধারণ ও বাতাস বিশুদ্ধ করতে নিম গাছের জুড়ি নেই। নিম গাছের বাতাস যেদিক দিয়ে যায়, সেখানে মশা, মাছি, পোকামাকড় থাকে না। রাসায়নিক সার, কিটনাশক, মশার কয়েল পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
নিমপাতা দিয়ে পরিবেশবান্ধব কীটনাশক, মশা তাড়ানোর ওষুধ, সার তৈরি করা যায়। তাপমাত্রা ও বায়ুদূষণ কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নিম গাছ। কৃষিকাজে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে নিমখোল ব্যবহার করলে মাটির গুণমান উন্নত হয়।
নিম গাছ মাটির পিএইচ নিয়ন্ত্রণ করে ও লবণাক্ততা কমায়। তাই সৌন্দর্যবর্ধনের নামে আগ্রাসী গাছ না লাগিয়ে নিম গাছ লাগালে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।