ডার্ক অক্সিজেন: গভীর সমুদ্রের অন্ধকারে অক্সিজেন উৎপাদনের রহস্য
আসিফ এম সামি
Email: asifsami@gmail.com
ডার্ক অক্সিজেন হল একটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার যা সম্প্রতি গভীর সমুদ্রের তলদেশে সূর্যালোক ছাড়াই অক্সিজেন উৎপাদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি বিজ্ঞানী সম্প্রদায়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করছে।
প্রবিত্র কুরআন শরীফে আছে আল্লাহ যা চান তাই করতে পারেন। মানুষের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে কিন্তু আল্লাহর জ্ঞান অসীম।
আমরা এতদিন জানতাম সুর্যের আলো ও গাছের সাহায্যে সালোক সংশ্লেষণের মাধ্যমেই অক্সিজেন তৈরী হয়ে এই পৃথিবীতে অক্সিজেনের ভরসাম্যতা আল্লাহ রক্ষা করেন। কেননা মানুষ অক্সিজেন ছাড়া একমুহূর্ত বাঁচতে পারে না। অথচ আল্লাহ সুবহানুতায়ালা কি সুন্দর ভাবে মানুষের অক্সিজেন চাহিদা পূরণ করছেন।
গাছ অক্সিজেন তৈরী করে আর মানুষ সেই অক্সিজেন গ্রহণ করে।
অবাক করার বিষয় হচ্ছে সম্প্রতি বিজ্ঞানের কল্যানে অবগত হওয়া যায় যে শুধু সালোকসংশ্লেষণ নয়, অর্থাৎ সূর্যের আলো ছাড়াও অক্সিজেন তৈরী হয় যা সমুদ্রের ৪ কিমি গভীরে পাওয়া গেছে যাকে বিজ্ঞানীর নাম দিয়েছেন “ডার্ক অক্সিজেন “।
ডার্ক অক্সিজেন কী?
ডার্ক অক্সিজেন বলতে বোঝায় সেই অক্সিজেনকে যা সূর্যের আলো ছাড়াই, সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যতীত গভীর সমুদ্রের অন্ধকার পরিবেশে তৈরি হচ্ছে। এটি একটি সম্পূর্ণ নতুন ধারণা, কারণ এতদিন বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে পৃথিবীর অক্সিজেনের প্রধান উৎস হল সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া যার জন্য সূর্যালোক প্রয়োজন।
এই আবিষ্কারটি করা হয়েছে প্রশান্ত মহাসাগরের ক্ল্যারিয়ন-ক্লিপার্টন জোন (CCZ) নামক অঞ্চলে, যা হাওয়াই ও মেক্সিকোর পশ্চিম উপকূলের মাঝামাঝি অবস্থিত একটি বিশাল সমুদ্রতল এলাকা ।
ডার্ক অক্সিজেনের উৎস
গবেষণায় দেখা গেছে যে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪,০০০ মিটার (১৩,১০০ ফুট) নিচে, সম্পূর্ণ অন্ধকারে অবস্থিত পলিমেটালিক নডিউল (বহু ধাতব গিঁট) থেকে এই অক্সিজেন উৎপন্ন হচ্ছে।
এই নডিউলগুলি আলুর আকৃতির পাথর বিশেষ যাতে ম্যাঙ্গানিজ, নিকেল, কপার, কোবাল্ট এবং জিঙ্কের মতো গুরুত্বপূর্ণ ধাতু রয়েছে ।

বিজ্ঞানীরা প্রস্তাব করেছেন যে এই নডিউলগুলি প্রকৃতপক্ষে প্রাকৃতিক “জিও-ব্যাটারি” হিসেবে কাজ করতে পারে, যেগুলো সমুদ্রের জলকে হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনে বিভক্ত করতে সক্ষম -একটি প্রক্রিয়া যা ইলেক্ট্রোলাইসিস নামে পরিচিত ।
আবিষ্কারের ইতিহাস
এই আবিষ্কারের সূত্রপাত হয় ২০১৩ সালে, যখন স্কটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর মেরিন সায়েন্সের গভীর সমুদ্রের বাস্তুবিদ অ্যান্ড্রু সুইটম্যান এবং তাঁর দল প্রথমবারের মতো গভীর সমুদ্রে অপ্রত্যাশিতভাবে উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন শনাক্ত করেন।
প্রথমে তারা ভেবেছিলেন এটি তাদের পরিমাপ যন্ত্রের ত্রুটি, কিন্তু পরবর্তীতে একাধিক অভিযানে একই ফলাফল পাওয়ায় তারা নিশ্চিত হন যে এটি একটি বাস্তব ঘটনা ।
২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে NORI-D লাইসেন্স এলাকায় একাধিক বেন্থিক চেম্বার ল্যান্ডার পরীক্ষা চালানো হয়, যেখানে দেখা যায় অক্সিজেনের মাত্রা আশ্চর্যজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গবেষকরা নডিউল, সামুদ্রিক পানি এবং পলির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে নিয়ে যান এবং দেখেন যে সমস্ত জীবাণু মার্কারি ক্লোরাইড দিয়ে মেরে ফেলার পরও অক্সিজেন উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে ।
প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া
গবেষক দল নডিউলগুলির পৃষ্ঠে ০.৯৫ ভোল্ট পর্যন্ত বৈদ্যুতিক বিভব পরিমাপ করেছেন, যা সমুদ্রের জলকে ইলেক্ট্রোলাইসিসের মাধ্যমে বিভক্ত করার জন্য যথেষ্ট হতে পারে । যদিও স্বাভাবিক অবস্থায় সমুদ্রের জলকে বিভক্ত করতে ১.২৩ ভোল্টের প্রয়োজন হয়, তবে ধাতব অনুঘটকের উপস্থিতিতে এই বিভবের প্রয়োজনীয়তা কয়েকশ মিলিভোল্ট পর্যন্ত কমে যেতে পারে ।
এই প্রক্রিয়াটিকে “জিও-ব্যাটারি” হাইপোথিসিস নামে অভিহিত করা হয়েছে, যেখানে নডিউলের বিভিন্ন ধাতব স্তরের মধ্যে সম্ভাব্য পার্থক্য ইলেকট্রনের অভ্যন্তরীণ পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন করে। গবেষকরা মনে করেন, নডিউলগুলির বৃহত্তর পৃষ্ঠ এলাকা এবং উচ্চ নিকেল ও কপার সমৃদ্ধ ডেনড্রিটিক স্তরগুলি এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে ।
এই প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে? (Mechanism)
এই অক্সিজেন উৎপাদনের মূল ভিত্তি Electrochemical Water Splitting:
H₂O → H₂ + ½ O₂
সমুদ্রের পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে behaving as natural electrodes সমুদ্রের পানির মাধ্যমে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে অ্যানোড-ক্যাথোড রিঅ্যাকশন হয় ফলে অক্সিজেন তৈরি হয় সম্পূর্ণভাবে আলো ছাড়াই।
বৈজ্ঞানিক বিতর্ক
এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। কিছু বিজ্ঞানী এই ফলাফল নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন এবং পদ্ধতিগত ত্রুটির সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন।
ফ্রান্সের ইফ্রেমারের ভূ-রসায়ন গবেষক অলিভিয়ের রুক্সেল বলেছেন যে পরিমাপকৃত অক্সিজেন আসলে আটকে থাকা বাতাসের বুদবুদ হতে পারে ।
জার্মানির জিওমার হেল্মহোল্টজ সেন্টার ফর ওশান রিসার্চের বায়োজিওকেমিস্ট ম্যাথিয়াস হেকেল মন্তব্য করেছেন যে, “তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ এবং অনুমানের জন্য স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করেননি” ।
২০২৪ সালের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচটি একাডেমিক গবেষণাপত্র জমা দেওয়া হয়েছে যা সুইটম্যানের গবেষণার ফলাফলকে খণ্ডন করে ।
এই আবিষ্কারের গুরুত্ব (Why this is revolutionary)
Biogenesis: এ থেকে বোঝা যায়, প্রাচীন পৃথিবীতে বা অন্য গ্রহে আলো ছাড়াও প্রাণ গঠনের উপাদান (oxygen) পাওয়া সম্ভব।
Exobiology: বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ইউরোপা (Jupiter’s moon) বা এনসেলাডাস (Saturn’s moon)-এও এমন প্রক্রিয়ায় জীবন থাকতে পারে
Deep Ocean Ecosystem: যারা ভাবত সমুদ্রের ৪ কিমি গভীরে অক্সিজেনের অস্তিত্ব নেই, তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

পরিবেশগত তাৎপর্য
এই আবিষ্কার গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরে। পরিবেশবাদীরা যুক্তি দেখান যে ডার্ক অক্সিজেনের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে আমরা এই গভীর সমুদ্রের জীবন সম্পর্কে কত কম জানি, এবং এটি গভীর সমুদ্রের খনন কাজের পরিবেশগত ঝুঁকির পক্ষে তাদের যুক্তিকে সমর্থন করে ।
গ্রিনপিস বলেছে, “গ্রিনপিস দীর্ঘদিন ধরে প্রশান্ত মহাসাগরে গভীর সমুদ্রের খনন কাজ বন্ধ করার জন্য প্রচারণা চালিয়ে আসছে, কারণ এটি সূক্ষ্ম গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি করতে পারে। এই অবিশ্বাস্য আবিষ্কার সেই আহ্বানের জরুরিত্বকে আরও জোরালো করে”।
ডার্ক অক্সিজেন | |
পবেষনার পদ্ধতি
| ![]() |
এই আবিস্কার কীভাবে কাজ করে?
| এ প্রক্রিয়া কীভাবে কাজ করে? পলিমেটালিক নডিউলস সূর্যালোকে ইলোক্টড হিসাবে কাজ করে। |
এই আবিস্কারের গুরুত্ব
| এই আবিস্কারের পরিবেশগত ঝুঁকি
|
জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে প্রভাব
এই আবিষ্কার পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকে চ্যালেঞ্জ করে। এতদিন ধরে মনে করা হত যে প্রায় ২.৭ বিলিয়ন বছর আগে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমেই পৃথিবীতে অক্সিজেন তৈরি হওয়া শুরু হয়েছিল, যা বহুকোষী জীবনের বিকাশের পথ প্রশস্ত করেছিল। কিন্তু এই আবিষ্কার ইঙ্গিত দেয় যে স্বাভাবিক অবস্থায় সমুদ্রের জলকে বিভক্ত, যা জীবনের উৎপত্তির তত্ত্বকে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করে ।
অ্যান্ড্রু সুইটম্যান বলেছেন, “বায়বীয় জীবন শুরু হওয়ার জন্য গ্রহে অক্সিজেন থাকা প্রয়োজন ছিল এবং আমাদের বোঝাপড়া ছিল যে পৃথিবীর অক্সিজেন সরবরাহ শুরু হয়েছিল সালোকসংশ্লেষণকারী জীবের মাধ্যমে। কিন্তু আমরা এখন জানি যে গভীর সমুদ্রে, যেখানে কোন আলো নেই, সেখানেও অক্সিজেন উৎপন্ন হচ্ছে। আমি মনে করি আমাদের তাই এমন প্রশ্নগুলি পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন: বায়বীয় জীবন কোথায় শুরু হতে পারত?”
ভবিষ্যতের গবেষণা
এই আবিষ্কার সম্পর্কে এখনও অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়েছে। বিজ্ঞানীরা এখন এই প্রক্রিয়ার সঠিক প্রক্রিয়া, এর স্থায়িত্ব এবং গভীর সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে এর ভূমিকা নিয়ে আরও গবেষণা করার পরিকল্পনা করছেন। বিশেষ করে, গভীর সমুদ্রের খনন কার্যক্রম এই প্রক্রিয়াকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে ।
সাসটেইনেবল ওশান অ্যালায়েন্স (SOA) এর মতে, “ডার্ক অক্সিজেন উৎপাদন, গভীর সমুদ্রের দ্বারা সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রকে প্রদত্ত আরেকটি সুবিধা, গভীর সমুদ্রের খনন এগিয়ে গেলে সম্ভবত হারিয়ে যেতে পারে। এই কারণেই খনন পদ্ধতিতে সতর্কতামূলক পদ্ধতি প্রয়োজন শুধুমাত্র তলদেশে বসবাসকারী গভীর সমুদ্রের জীবের নয়, সমুদ্রের সমগ্র সূক্ষ্ম বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষার জন্য”।
উপসংহার
ডার্ক অক্সিজেনের আবিষ্কার বিজ্ঞানের জগতে একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এটি শুধুমাত্র সমুদ্রবিজ্ঞান নয়, জীবনের উৎপত্তি, পৃথিবীর প্রারম্ভিক পরিবেশ এবং সম্ভবত অন্যান্য গ্রহে জীবনের সম্ভাবনা সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়াকেও প্রভাবিত করতে পারে। তবে এই আবিষ্কার এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং আরও বিস্তৃত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে যাতে এই প্রক্রিয়ার সঠিক প্রক্রিয়া এবং এর বৈশ্বিক প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
যেমনটি অ্যান্ড্রু সুইটম্যান বলেছেন, “আমি মনে করি এই বিষয়ে আরও বিজ্ঞান প্রয়োজন, বিশেষ করে এই প্রক্রিয়া এবং এর গুরুত্ব সম্পর্কে। আমি আশা করি এটি কিছু আশ্চর্যজনক কিছুর সূচনা” ।
(সংকলিত)