দক্ষিণাঞ্চলের নদ–নদী, ইলিশ ও লবণ রক্ষার দাবিতে জরুরি পদক্ষেপ: পরিবেশ সুরক্ষার আহ্বান
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের নদ–নদী গুলোর অবস্থান একসময় ছিল স্থানীয় সম্প্রদায় এবং ইকোসিস্টেম এর প্রাণকেন্দ্র। কিন্তু এখন এই নদীগুলো মারাত্মক হুমকির মুখে।
এই নদীগুলো মাছ ধরার, লবণ উৎপাদন, এবং পানি সেচ ও পরিবহন এর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বর্তমানে, এসব নদী দ্রুত তার নাব্যতা এবং পবিত্রতা হারাচ্ছে। এর ফলে, ইলিশ মাছ যা দেশীয় অর্থনীতি এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য, তা এখন বিপদের মুখে। এই অবস্থায়, দেরি না করে এখনই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
সম্প্রতি বরিশালে বেলা (বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি) আয়োজিত একটি নেটওয়ার্কিং মতবিনিময় সভায় পরিবেশবিদরা এবং স্থানীয় সংগঠকরা দক্ষিণাঞ্চলের নদ–নদীগুলোর অবনতির উপর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং সেখানকার পরিবেশগত ক্ষতির পরিণতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। যেখানে ইলিশ মাছ এবং হাজার হাজার মানুষের জীবনযাত্রা সংশ্লিষ্ট, সেখানে এখনই কর্মসূচি গ্রহণ না করলে ভবিষ্যতে বিপর্যয় হতে পারে।
বরিশাল বিভাগ বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদীগুলোর জায়গা, যেমন রাবনাবাদ চ্যানেল, পায়রা নদী, বিষখালী নদী, এবং বলেশ্বর নদী। এই নদীগুলো বর্তমানে সিলটেশন, দূষণ, দখল এবং অব্যাহত উন্নয়ন এর কারণে গুরুতর অবনতির সম্মুখীন। এক সময় যা ছিল সম্পদপূর্ণ নদী, আজ তা নাব্যতা হ্রাস ও মাছের প্রজনন ক্ষেত্র সঙ্কুচিত হয়ে গেছে, যা জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করছে।
এই ইকোসিস্টেমের সবচেয়ে বড় হুমকি হলো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং অন্যান্য শিল্প, যেগুলো নদীগুলিতে অবৈধ বর্জ্য ফেলে।
বিশেষ করে রাবনাবাদ চ্যানেল এখন কয়লা পরিবহণ এর কারণে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে গেছে। উন্মুক্ত কয়লা পরিবহন এবং শক্তির প্রকৃত ব্যবস্থাপনার অভাব এর ফলে নদীর পানি বিষাক্ত হয়ে গেছে, যা ইলিশ মাছের প্রজনন এবং বিচরণ বিপন্ন করে তুলছে।
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ তার প্রজনন ক্ষেত্র হ্রাস ও অতিরিক্ত মাছ ধরা এর কারণে সংকটে পড়েছে। দূষণ এবং জমি দখল প্রক্রিয়া এতে যোগ হয়ে ইলিশ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর প্রাকৃতিক আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা স্থানীয় মৎস্য শিল্প কে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে।
এর পাশাপাশি, ভোলা ও পটুয়াখালী এর কিছু এলাকায় দখলদারির ফলে নদীগুলোর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ভোলা খাল বর্তমানে প্রায় মৃত হয়ে গেছে, এবং মেঘনা নদী এর তীরে একটি বস্ত্রকল স্থাপন হচ্ছে, যা বর্জ্য নিঃসরণ করে নদীকে আরও দূষিত করবে।
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা এর কয়লা পরিবহন এর জন্য রাবনাবাদ চ্যানেল বিপদে পড়েছে। ১,৩২০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা পরিবহন করছে, যা নদীকে দূষিত করছে এবং ইলিশের প্রজনন ও বিচরণ হুমকির মুখে ফেলছে।
এছাড়া, বরগুনার বিষখালী নদী এর বরগুনার বাইনচটকি এলাকায় ইটভাটার মালিক নদী দখল করে মাছের ঘের গড়ে তুলেছেন। এই ধরনের দখল এবং স্থাপনা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করছে এবং নদী রক্ষার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বেলা’র মাঠ সমন্বয়ক এ এম এম মামুন জানান, আগামী এক বছরের কর্মপরিকল্পনায় এসব নদী এবং পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতা সৃষ্টি এবং আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এই দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলোর সুরক্ষা এবং ইলিশের প্রজনন রক্ষা একটি জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারকে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে নদী দখল ও দূষণ রোধ করা যায়। এজন্য স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশবাদী সংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়া, নবায়নযোগ্য শক্তির দিকে চলে যেতে হবে, যাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এসব পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ক্লাইমেট অ্যাকশন এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
দক্ষিণাঞ্চলের নদীগুলো এবং ইলিশের সুরক্ষা বাংলাদেশসহ পুরো পৃথিবীর জন্য একটি গুরুতর পরিবেশগত এবং অর্থনৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলের সাজেশন, সহযোগিতা এবং সচেতনতা দ্বারা এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। নদী রক্ষা এবং পরিবেশ সুরক্ষা বিষয়গুলো আমাদের দায়িত্ব, যা আমাদের আগামী প্রজন্ম এর জন্য একটি সবুজ এবং সুরক্ষিত পৃথিবী নিশ্চিত করবে।