দূষণ রক্ষায় বাসযোগ্য করতে হবে ঢাকার পরিবেশ
রাজধানী ঢাকা বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল নগরীর অন্যতম। আধুনিক নগর ব্যবস্থায় যে সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তার অনেকটাই অনুপস্থিত এখানে। মূলত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অধিকাংশ অফিস, আদালত, কর্মসংস্থানসহ মানুষের অপরিহার্য প্রায় সব সেবা ও সুযোগের ব্যবস্থা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ প্রতিনিয়ত রাজধানীমুখী হচ্ছে।
তা ছাড়া অনুরূপ সেবা ও সুযোগের আশায় মানুষ ঠাঁই নিচ্ছে শহর ছেড়ে নিকটস্থ বিভাগীয় ও জেলা শহরেও। একই সঙ্গে নগরায়ণের ফলে দেশের অন্য নগরগুলোতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জনসংখ্যা। নগরায়ণও হচ্ছে দ্রুতগতিতে।
সেই সঙ্গে নগরীতে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বিবিধ সমস্যা। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট, যানবাহন সংকট, জলাবদ্ধতা, দূষণ ও যানজট, জলজট, মানব জটের পাশাপাশি নতুন নতুন অসংখ্য সংকট নগরবাসীর ঘাড়ে চেপে বসছে।
এর বিপরীতে নগরীর বাসযোগ্যতা রক্ষার জন্য যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তা সময় উপযোগী নয়, আবার তা বাস্তবায়নেও রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা। ফলে নগরগুলো দিন দিন আরও বাসযোগ্যহীন হয়ে পড়ছে।
নগরীর এই ক্রমবর্ধমান সমস্যা নিরসনে ঢাকাকে বৃত্তাকার সড়ক, নৌ, রেল যোগাযোগের আওতায় আনা, রাজধানীর নিকটস্থ জেলা,উপজেলায় পরিকল্পিত উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, অফিস, আদালত স্থানান্তর ও নতুন করে গড়ে তোলা, দেশের জেলা শহরগুলোকে হাব হিসেবে ধরে নিয়ে পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
জেলাপর্যায়েই তৈরি করতে হবে কর্মসংস্থান। জেলার সঙ্গে গ্রামকে যুক্ত করে সুষম উন্নয়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। টেকসই ও বাসযোগ্য নগরায়ণে এসবের বিকল্প নেই।
নগরীকে বাসযোগ্য করার ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে সরকারি, বেসমরকারি বিভিন্ন সংস্থা প্রায়শই নানান উদ্যোগ আয়োজন করে থাকে। ঠিক এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ণ: সমস্যা ও সমাধান’ শীর্ষক এক বিশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতেও প্রায় অভিন্ন এমন অভিমত উঠে এসেছে।
ওই অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহানের পরামর্শ, অতি নগরায়ণের ফলে যানজট বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নগরায়ণের ঝুঁকি বাড়ছে। সমন্বয়হীনতার কারণে দ্রুত নগরায়ণ সম্প্রসারিত হচ্ছে।
আবাসন কোম্পানিগুলোর চটকদার বিজ্ঞাপনের ফলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সেখানেও নাগরিক সুবিধার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের অভিমত, শহরে দিন দিন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু নগর উন্নয়নের দায়িত্বে কোনো একজন সুনির্দিষ্ট মন্ত্রী নেই। যে দেশের ৩৬ শতাংশ মানুষ শহরে বাস করে সেখানে একজন নগর বিষয়কমন্ত্রী থাকা প্রয়োজন। আগামী ডেল্টা প্ল্যানে শহরের লোকসংখ্যা আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, দেশে নগরায়ণ বাড়ছে। ১৯৭৪ সালে দেশে নগরায়ণের হার ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশ। ১৯৮১ সালে হয় ১৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ, ১৯৯১ সালে ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ, ২০০১ সালে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৩১ শতাংশ এবং ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ৩৯ দশমিক ৭১ শতাংশে।
নগরায়ণের ক্ষেত্রে ঢাকা বিভাগ সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে। সবচেয়ে পিছিয়ে আছে সিলেট বিভাগ। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ১৫টি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা এসব প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের সমাপনী পর্বে একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
একজন পরিবেশবিদ বলেন, বাসযোগ্য নগরীতে ১২ শতাংশ উন্মুক্ত স্থান ও ১৫ শতাংশ এলাকায় সবুজের আচ্ছাদন থাকার কথা কিন্তু আছে সামান্য। ঢাকা শহরের সঙ্গে যুক্ত আটটি নদী ঘিরে সার্কুলার নৌপথ চালু করতে না পারাটা আমাদের ব্যর্থতা। যানজটের ভারেও নাকাল হয়ে আছে ঢাকা।
গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হকের অভিমত, যানজট নিরসন করতে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজ করার কাজও প্রথম ধাপে রয়েছে। এটাকে সামনের দিকে নিতে না পারলে কার্যকর গণপরিবহন ব্যবস্থা কোনোভাবেই গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
জনঘনত্ব ও শহরের উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এলাকাভিত্তিক জনঘনত্বের ম্যাপ তৈরি করা। এলাকাভিত্তিক সামাজিক ও নাগরিক সুবিধা ও অবকাঠামোর তালিকা প্রস্তুত করা। সেই অনুযায়ী উন্নয়ন অনুমোদন দেওয়া। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ নয় বরং সামগ্রিক টেকসই শহরের উন্নয়নকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রসঙ্গত ঢাকা মাঝেমধ্যেই বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষস্থান করে নেয়। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু কমছে দুই বছর চার মাস। তবে বাংলাদেশে কমছে ছয় বছর আট মাস। এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়, গত ৩৩ বছরে রাজধানীতে থেকে বিলুপ্ত অথবা উধাও হয়েছে ১৯০০ পুকুর।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দখলদারিত্বও বিপুল পরিমাণ আবাসন চাহিদার কারণে ১৯৮৫ সাল থেকে এই পর্যন্ত গত ৩৩ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঢাকার ১ হাজার ৯০০ সরকারি-বেসরকারি পুকুর ও জলাধার। এসব পুকুরের মোট জমির পরিমাণ ৭০ হাজার হেক্টর। এই পুকুরগুলো এক সময় ছিল পানি ধরে রাখার অন্যতম মাধ্যম।
ফলে জলাবদ্ধতা নিরসন, অগ্নিনির্বাপণ, পানীয় জলের সংকট নিরসনে এগুলোর ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যান মতে, ১৯৮৫ সালের দিকে ঢাকায় মোট পুকুর ছিল দুই হাজার। বেসরকারি হিসাবমতে, এ বছর পর্যন্ত তা এসে ঠেকেছে এক শতে।
যদিও ঢাকায় পুকুরের প্রকৃত সংখ্যা কত সে হিসাব নেই দুই সিটি করপোরেশনের কাছে। ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংয়ের এক সমীক্ষা রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গত সাড়ে তিন দশকে হারিয়ে গেছে ঢাকার ১০ হাজার হেক্টরের বেশি জলাভূমি, খাল ও নিম্নাঞ্চল।