নদী দূষণের অন্যতম কারন প্লাষ্টিক
প্লাষ্টিক ও পলিথিন উৎপাদন রোধ না করলে আগামী এক দশকের মধ্যে এর দূষণে ছেয়ে যাবে বিশ্ব। এমনই সতর্কবার্তা দিয়েছেন নরওয়ের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক মন্ত্রী অ্যান বিথ টিভিনেরেইম।
২৪ শে মার্চ’২৫ এক প্রতিবেদনে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় এ খবর জানিয়েছে রুয়ান্ডা ও নরওয়েসহ প্লাষ্টিক দূষণ মোকাবেলা করতে চায় এমন ৬০টির বেশি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন বিথ টিভিনেরেইম।
তিনি প্লাষ্টিক বর্জ্য রোধে এমন একটি চুক্তির আশা করেছেন যাহা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ দূষণরোধে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করবে। কিন্তু বিরোধী দেশগুলোর জন্য এমন একটি ট্রিটি বা চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের নমুনা যেমন; জরায়ু, অন্ডকোষ, বীর্য ও ধমনীতে মাইক্রপ্লাষ্টিক খুজে পাওয়া গেছে।
এটা প্লাষ্টিকের ব্যাপ্তি ও স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টিই তুলে ধরে। প্লাষ্টিকের সংকট মানবস্বাস্থ্য, জীববৈচিত্র ও জলবায়ুর জন্য হুমকিস্বরূপ। এ বিষয়ে ১৭৫ টি দেশ একটি ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষরের দুই বছর পার হলেও বিশ্বে এখনও ৭১২ বিলিয়ন ডলারের প্লাষ্টিক শিল্প কমানোর অগ্রগতি থমকে আছে।
বক্তব্য রাখার সময় বিথ টিভিনেরেইম প্লাষ্টিক পূর্ণব্যবহার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছেন। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে প্লাষ্টিকের উৎপাদান ও ব্যবহার কমানোর প্রয়োজনীয়তার উপরও জোর দিয়েছেন তিনি।
জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কর্মসূচি (ইউএনইপি) তাদের বিশ্বব্যাপী প্লাষ্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার বিষয়ক প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের পদ্মা, মেঘনা, যমুনা নদী দিয়ে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাষ্টিক বর্জ্য সাগরে মিশে যাচ্ছে। এছাড়া ভারত, নেপাল ও চীনের বর্জ্য গঙ্গা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে প্রবাহিত হচ্ছে।
প্লাষ্টিক ও পলিথিনের এ ধরনের অবাধ ব্যবহার নানা মাত্রায় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহারে বর্ষাকালে নগর-মহানগরে পয়োনিষ্কাশনে ড্রেন, নালা-নর্দমা ভরাট হচ্ছে। অন্যদিকে প্লাষ্টিক ও পলিথিন দূষণের কারণে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও ভূমিতে ব্যাপক দূষণ ঘটায় যার ফলে গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে।
প্লাষ্টিক ও পলিথিন সাগরের তলদেশে জমে জীববৈচিত্র ও সামুদ্রিক জীবের মারাত্মক ক্ষতি করছে। পরিত্যক্ত প্লাষ্টিক, মাইক্রোপ্লাষ্টিকে পরিণত হয়ে বাতাস, পানি ও খাবারের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করছে। এ অনুপ্রবেশের কারণে দীর্ঘ মেয়াদে ফুসফুস, কিডনীজনিত রোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি তৈরি করছে।
পেটের পীড়া, হরমোনের সমস্যা, লিভারের সমস্যা এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মত ভয়ঙ্কর রোগের জন্য দায়ী এ প্লাষ্টিক সামগ্রী।
পলিথিন ও প্লাষ্টিক বর্জ্যসহ ব্যাপকভাবে অন্য বর্জ্য ফেলার কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষা, বালু, কর্ণফুলী ও সুরমা নদী বাংলাদেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে। পলিথিন ও প্লাষ্টিক বর্জ্যে এ নদীগুলোর মরণদশা। অন্যদিকে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী দিয়ে প্রতিদিন ৭৩ হাজার টন প্লাষ্টিক বর্জ্য সাগরে দিয়ে পড়ে।
সমুদ্রের তলদেশে প্লাষ্টিক-পলিথিনের স্তর যে হারে বাড়ছে তাতে আগামী ৫০ বছর পর সমুদ্রে মাছের চেয়ে পলিথিনের পরিমাণ বেশি হবে। রাজধানীতেই প্রতিদিন ব্যবহার হচ্ছে দেড় কোটি পিস পলিথিন। আর পলিথিন উৎপাদনে সারাদেশে প্রায় দেড় হাজার কারখানা রয়েছে।
পলিথিনের বাইরে দেশে প্লাষ্টিকের ব্যবহারও বিপজ্জনক হারে বাড়ছে। বছরে রাজধানীতে গড়ে মাথাপিছু প্লাষ্টিকের ব্যবহার ২৪ কেজির বেশি।
প্লাষ্টিক ও পলিথিনের মাত্রাতিরিক্ত এ ব্যবহারে ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ, ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নদী ও সাগর। প্লাষ্টিক ও পলিথিনের কারণে বর্ষাকালে ভেঙ্গে পড়ে দেশের ড্রেনেজব্যবস্থা আর মানবস্বাস্থ্যের নানাহ রোগ তৈরি করছেই।
দেশে প্লাষ্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার কি পরিমাণে বাড়ছে তার বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এবং বিশ্বব্যাংক। ২০০৫ সালে দেশের শহরাঞ্চলে বছরে মাথাপিছু প্লাষ্টিকের ব্যবহার ছিল মাত্র ৩ কেজি।
সেটি ২০২০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৯ কেজিতে উন্নীত হয়েছে। বর্তমানে শুধু রাজধানীতেই একজন মানুষের বছরে প্লাষ্টিকের ব্যবহার ছাড়িয়েছে ২৪ কেজি। যদিও পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর বিধান অনুসারে দেশে ২০০২ সাল থেকে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপনন, পরিবহন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ রয়েছে।
বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ হয় বাংলাদেশে। সারাদেশে কত সংখ্যক অবৈধ পলিথিন কারখানা রয়েছে সে জরিপ করে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। জরিপে দেখা গেছে, রাজধানীসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির কারখানা রয়েছে প্রায় দেড় হাজার। যার বেশির ভাগ রাজধানীর পুরাণ ঢাকায় ও গাজীপুর কেন্দ্রিক।