পরিবেশ ক্ষতির অন্যতম বড় কারণ দৃশ্যদূষণ
সম্প্রতি রাজধানীতে মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানোর অভিযোগে ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। মেট্রোরেলের পিলারে পোস্টার লাগানো বন্ধে সিটি করপোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবেন।
যেখানে-সেখানে পোস্টার, ব্যানার, বিলবোর্ড ইত্যাদি শুধু যেকোনো স্থাপনার কাজের জন্য বাধা বা সমস্যা তৈরি করে তা নয়, সে সঙ্গে এগুলো দৃশ্যদূষণের অন্যতম বড় কারণ।
কয়েক দশক ধরে আলোচিত বিষয়গুলোর অন্যতম হচ্ছে পরিবেশ ও এর বিপন্নতা, যা নিয়ে চিন্তিত সমগ্র বিশ্বের মানুষ। বিভিন্ন আইন প্রণয়ন, সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, তারপরও থেমে নেই দূষণ।
পরিবেশের সমস্যা বহুমাত্রিক। পরিবেশ দূষণের কথা এলেই বায়ু, পানি ও শব্দদূষণের কথা বলা হয়। কিন্তু এসব ছাড়া বর্তমানে এখন আরেকটি দূষণের কথা বলা হচ্ছে, সেটি হলো ‘দৃশ্যদূষণ’।
দৃশ্যদূষণ একটি নান্দনিক সমস্যা। এটি দূষণের প্রভাবগুলোকে বোঝায়, যা একটি দৃশ্য বা দৃষ্টিভঙ্গি উপভোগ করার ক্ষমতা হ্রাস করে। দৃশ্যদূষণ প্রাকৃতিক পরিবেশে ক্ষতিকারক পরিবর্তন তৈরি করে মানুষের দর্শনীয় স্থানগুলোকে বিরক্তিকর করে তোলে।
যেখানে সেখানে পোস্টার, বিলবোর্ড, অবৈধ দেয়াললিখন, আর্বজনা, অ্যান্টেনা, বৈদ্যুতিক তার, ভবন এবং যানবাহনগুলোর উন্মুক্ত অবস্থান প্রায়ই দৃশ্যদূষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
কোনো অঞ্চলে অতিরিক্ত লোকজনও দৃশ্যদূষণের কারণ হয়। চাক্ষুষ দূষণের সংস্পর্শে প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- বিক্ষিপ্ততা, চোখের ক্লান্তি, মতামতের বৈচিত্র্য হ্রাস এবং পরিচয় হ্রাস। এ ধরনের দৃশ্যদূষণের আরেকটি ফলাফল হচ্ছে পর্যটনবিমুখতা।
রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলোতে রাস্তায় বের হলেই শুধু চোখে পড়ে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের বড় বড় ব্যানার, পোস্টার, বিজ্ঞাপন। রাস্তার পাশের স্থাপনাগুলোর দেয়াল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, উড়াল সেতুর পিলার- সর্বত্র পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদির ছড়াছড়ি। এ ছাড়া রয়েছে বিদ্যুতের তার, ইন্টারনেটের তার, ডিশ লাইনের তার।
আর এ যেন পুরো শহরকে মাকড়শার জালের মতো জড়িয়ে রেখেছে। যার ফলে রীতিমতো এক ধরনের আতঙ্ক নিয়েই বাস করতে হয়। সবচেয়ে বড় আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন তার। বৈদ্যুতিক তারগুলো কোনো একটি কর্ডের ভেতর থাকে না। তাই সব সময়ই মনে হয়, যেকোনো সময়ই একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
আমরা অনেকেই দেশ-বিদেশে ভ্রমণে গেলে কোথাও এই ধরনের দৃশ্যদূষণ তথা যেখানে-সেখানে পোস্টার, বিলবোর্ড, আবর্জনা, অ্যান্টেনা, বৈদ্যুতিক তার, ভবন এবং অটোমোবাইলগুলোর উন্মুক্ত অবস্থান দেখতে পাই না, শুধু আমাদের দেশ ও প্রতিবেশী দু-একটি দেশ ছাড়া।
দৃশ্যদূষণ না থাকার কারণে ওসব দেশে পরিবেশ দূষণ যেমন কমছে, তেমনি শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে তাদের পর্যটনশিল্প। ওই দেশগুলোর তুলনায় পরিবেশ রক্ষা ও পর্যটন- উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দিন দিন পিছিয়ে পড়ছি, যা কখনোই আমাদের দেশের জন্য ইতিবাচক নয়।
বর্তমানে আমাদের দেশের বড় শহরগুলোতে বিলবোর্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু বড় শহরগুলোর বাইরে বের হলেই হাইওয়েগুলোর দুই ধারে, জেলা শহর ও মফস্বলে এখনো মিলছে বড় বড় বিলবোর্ড। অতীতে আমরা দেখেছি ঝড়ে বিলবোর্ড ভেঙে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে।
তার পরও এ ধরনের বিলবোর্ড চিরতরে বন্ধের উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। বড় বড় এই বিলবোর্ড একদিকে যেমন দৃশ্যদূষণ করছে, একইভাবে মানুষের প্রাণহানির কারণও হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতা দৃশ্যদূষণের আরেকটি কারণ। বেশির ভাগ বিলবোর্ড, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়াই এগুলো লাগানো হয়।
আমাদের চারপাশে ঘিরে থাকা সামাজিক ও প্রাকৃতিক সব কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ। আজ আমরা সবদিকেই দূষণের শিকার। শুধু বস্তাপচা বুলি আওড়ে, নিয়ম বানিয়ে এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়, প্রয়োজন আইনের সঠিক প্রয়োগ।
দেয়াললিখন ও পোস্টার নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১২ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। দৃশ্যদূষণ প্রতিরোধ অবৈধ দেয়াললিখন, পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড অপসারণে অভিযান জোরদার করতে হবে। যথাযথভাবে যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে দূষণের প্রভাব থেকে আমাদের দেশ ও জাতিকে রক্ষার উদ্যোগ নেয়া এখন জরুরি।