পরিবেশ সংকটের শিকড়: প্রযুক্তি নাকি আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতা?
জলবায়ু পরিবর্তন, বন উজাড়, দূষণ ও পানি সংকট—আজকের পৃথিবী যেন এক অভূতপূর্ব পরিবেশ সংকটের মধ্যে নিমজ্জিত। বৈশ্বিক নেতারা কার্বন নিঃসরণ কমানো, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার কিংবা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মতো নানা প্রযুক্তিগত সমাধান খুঁজছেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এসব পদক্ষেপ কি যথেষ্ট? অনেক পরিবেশবিদ এবং ধর্মীয় চিন্তাবিদ মনে করেন, সংকটের শিকড় কেবল প্রযুক্তি বা অর্থনীতির সীমাবদ্ধতায় নয়, বরং মানুষের আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতায় নিহিত।
শিল্পবিপ্লবের পর মানুষ প্রকৃতিকে ধীরে ধীরে কেবল এক ধরনের সম্পদভাণ্ডার হিসেবে দেখা শুরু করে। অর্থনীতি তাকে মুনাফার উৎসে রূপ দেয়, বিজ্ঞান তাকে বিশ্লেষণ ও নিয়ন্ত্রণের উপাদান বানায়, আর প্রকৌশল তাকে শাসনের কৌশলে পরিণত করে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই বিচ্ছেদ তৈরি করেছে গভীর এক ভারসাম্যহীনতা। মানুষ নিজেকে প্রকৃতির অংশ নয়, বরং তার মালিক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। অথচ ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি বলে প্রকৃতি কোনো জড় সম্পদ নয়, বরং এটি একটি জীবন্ত সম্প্রদায়। সৃষ্টির প্রতিটি উপাদানই আল্লাহর মহিমা ঘোষণা করে। কোরআনে বলা হয়েছে, “পৃথিবীতে বিচরণশীল সকল প্রাণী এবং আকাশে উড়ন্ত পাখিরা তোমাদের মতোই সম্প্রদায়।” (সুরা আনআম, ৩৮)
আধ্যাত্মিক শিক্ষা তাই আমাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেয় প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বের কথা। কোরআনের বহু আয়াতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রকৃতি আল্লাহর সৃষ্টি এবং এর ভারসাম্য রক্ষা করা মানুষের অন্যতম কর্তব্য। “তিনি আকাশকে উঁচু করেছেন এবং ভারসাম্য স্থাপন করেছেন, যাতে তোমরা ভারসাম্য লঙ্ঘন না করো।” (সুরা রাহমান, ৭–৮)। রাসুল (সা.) প্রকৃতির প্রতি করুণা ও সহানুভূতির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “যে ব্যক্তি একটি গাছ রোপণ করে এবং তা থেকে মানুষ, পশু বা পাখি উপকৃত হয়, তা তার জন্য সদকায়ে জারিয়া।” (সহিহ মুসলিম)। এমনকি আরেকটি হাদিসে তিনি পরামর্শ দেন, “যদি কিয়ামতের সময় এসে যায় এবং তোমার হাতে একটি চারা থাকে, তবে তা রোপণ করো।” (মুসনাদে আহমদ)। এই বাণীগুলো শুধু আধ্যাত্মিক নির্দেশ নয়, বরং মানবজাতির জন্য সুস্পষ্ট পরিবেশনীতি।
ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানও প্রকৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সূর্যের গতিবিধির ওপর নির্ভরশীল, ওজুতে পানির সংযম শেখানো হয়, আর ইসলামি ক্যালেন্ডার নির্ধারিত হয় চাঁদের পর্যায়ের ভিত্তিতে। এই সংযোগ প্রমাণ করে মানুষের আধ্যাত্মিক চর্চা প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে একেবারেই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
তাহলে আজকের শিক্ষা কী? পরিবেশ সংকট মোকাবেলায় কেবল প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক সমাধান যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন মানসিকতা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন। বিজ্ঞানকে শুধু বিশ্লেষণ নয়, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা বোঝার দিকে মনোযোগী হতে হবে। অর্থনীতির লক্ষ্য হতে হবে শুধু মুনাফা নয়, বরং টেকসই কল্যাণ। প্রকৌশলকে প্রকৃতির সঙ্গে সুর মিলিয়ে চলতে হবে। কোরআনের নির্দেশনা “সংশোধনের পর পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না” (সুরা আ’রাফ, ৫৬) আজও সমান প্রাসঙ্গিক।
পরিবেশ সংকটকে তাই কেবল জলবায়ু পরিবর্তন বা দূষণের ফল বলা যাবে না। এটি মানবজাতির আধ্যাত্মিক বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলনও বটে। ইসলামি শিক্ষা আমাদের শেখায়—আমরা পৃথিবীর অভিভাবক, এর মালিক নই। যদি আমরা প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই, ভারসাম্য বজায় রাখি এবং পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ করি, তবে আমরা কেবল পৃথিবীকে রক্ষা করব না, বরং স্রষ্টার সন্তুষ্টিও অর্জন করব।