পরিবেশ সংরক্ষণে সরকারের রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন পরিবেশ অধিদফতরের
বাংলাদেশের সরকারি দফতরগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও কাজ করে পরিবেশ অধিদফতর। কিন্তু পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারের রাজনৈতিক সহযোগিতা পায় না বলে দখল-দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
রাজনৈতিক সহায়তা পেলে এই সংস্থাটি যে পরিবেশ সংরক্ষণে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে তার বড় নজির দেখেছি আমারা ২০০২-২০০৪ সালে। সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছিল বলে সেই সময় প্লাস্টিক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছিল বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তার এই বক্তব্যের জবাবে পরিবেশ উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি দাবি করেছেন, জনগণের সচেতনতা ও সদিচ্ছার অভাবে পরিবেশ দূষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না।
শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবে না বলে জানিয়ে পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে বাধ্য করতে জনগণের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপমন্ত্রী।
রবিবার বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর কনফারেন্স হলে ‘বায়ুমান এবং জ্বালানী উন্নয়নে নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা’ বিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকে তারা একথা বলেন।
বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বি.আই.পি) যৌথভাবে এই গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে। উক্ত আয়োজনে সহ-আয়োজক ছিল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর), পিওর আর্থ বাংলাদেশ, নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্ট, সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিজিইডি), পরিবেশ উদ্যোগ, এবং ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
বিআইপি এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমনের সভাপতিত্বে গোলটেবিল বৈঠকে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।
মূল বক্তব্যে বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ এর নানান ত্রুটি তুলেন এই বায়ুমান বিজ্ঞানী। তিনি জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত বস্তুকণা ২.৫ এর উপস্থিতিকে মানুষের জন্য নিরাপদ ধরা হয়।
বাংলাদেশের মান মাত্রায় এটি ১৫ মাইক্রোগ্রাম। অথচ এখন দূষণকারীদের সুযোগ দিতে এই বিধিমালায় প্রতি ঘণমিটার বাতাসে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম বস্তুকণা ২.৫কে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আইনের ফাঁকে বিদেশি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো নির্ধারিত মানমাত্রা না মেনে বায়ু দূষণ করে দেশের মানুষকে অসুস্থ করে তুলছে।
দেশের বায়ু দূষণ মোকাবিলায় ৪টি সুপারিশও তুলে ধরেন তিনি। সেগুলো হলো-
- (১) বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ এ বস্তুকণা ২.৫ এর পূর্ববর্তী মান প্রতিঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম বজায় রাখা
- (২) উন্নয়ন সহযোগিতা প্রদানকারী দেশগুলো নিজ দেশে যেভাবে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মাত্রা বজায় রাখে একইভাবে বাংলাদেশেও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মাত্রা বজায় রাখা
- (৩) পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত বায়ু দূষণ নির্দেশিকার ১৬ নং পৃষ্ঠার ১৯ নং ক্রমে উল্লেখিত কম সালফারযুক্ত (৫০ পিপিএম) ডিজেল আমদানি ও ব্যবহার নিশ্চিত করা
- (৪) সকল কয়লা, তেল ও গ্যাস ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্টকে পূর্বের মত লাল শ্রেণীভুক্ত রাখা।
গোলটেবিল বৈঠকে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, বিধিমালায় দূষক গুলোর আদর্শমানগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে মিল রেখে সংশোধনী জরুরী। তিনি সকল শিল্পকারখানা গুলোতে EIA এর পাশাপাশিই EMP বাধ্যতামূলক করার জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাই বায়ুকে দুষণমুক্ত রাখতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে ও জ্বালানি নিরাপত্তায় নবায়নযোগ্য শক্তির কোন বিকল্প নেই।
বিআইপি এর উপদেষ্টা পরিষদের আহবায়ক অধ্যাপক ড. মো. আকতার মাহমুদ বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারের মাধ্যমে বায়ুমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য গবেষণা সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।
এক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তিকে ব্যবসায়ীদের পন্য হিসেবে পৌঁছাতে পারলে এটির প্রসার করা সম্ভব। সরকারকে বায়ু দূষণরোধে আইন প্রনয়নের ক্ষেত্রে সতেষ্ট হতে হবে তা নাহলে আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কিছুই দেখে যেতে পারবো না।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, বায়ুদূষণ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মারাত্নক মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে পরিত্রান পেতে জৈব জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রমোট করতে হবে।
বাংলাদেশে সৌর শক্তির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য আমাদের আচরণগত ও মানসিককতায় পরিবর্তন আনতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আপাত দৃষ্টিতে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যয় বেশি হলেও, যে হারে অন্যান্য জ্বালানির দাম বাড়ছে খুব শিগগিরি এই সব জ্বালানি ব্যয় বহন করা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে চলে যাবে। তখন দেখা যাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যয় কম এবং তাই আমাদের এখন থেকে এই নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রমোট করলাম।
আইন ও বিধিমালা গুলোতে অনেক গ্যাপ আছে, এই ঘাটতি গুলোকে সমাধান করে বিধিমালা গুলোকে যুগ উপযোগী করে তোলার দাবি জানান তিনি।
বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ অধিদফতর চাইলে এককভাবে পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে শেষ করতে পারবে না এর জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়কেও সাহায্য করতে হবে। বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের স্ট্যান্ডার্ড একই হওয়া উচিত, তবে দেশের পরিবেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজস্ব একটি রোডম্যাপ ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০২২ কে অকার্যকর ভাবার কোন সুযোগ নেই, এতে কিছু ত্রুটি আছে সেগুলো সংশোধনের পাশাপাশি আমাদেরকে বিধিমালা ভালো দিকগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে।
সরকারি অন্যান্য সংস্থার তুলনায় আমাদের পরিবেশ অধিদপ্তর কিছুটা হলেও কাজ করে। কিন্তু তাদের বড় সংকট রাজনৈতিক সমর্থনের অভাব। রাজনৈতিক সমর্থন পেলে ভালো কাজ করার নজির এ সংস্থাটি ২০০২-২০০৪ সালে পলিথিন নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার এমপি বলেন, আমারা আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাতাসকে দূষিত করছি, তাই এখন আর আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাস পাই না। শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবে না।
ব্যক্তি পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহ দেখাতে হবে, দেশের নাগরিক হিসেবে সবাইকে সবার অবস্থান থেকে বায়ু দূষণ কমাতে সচেষ্ট হতে হবে এবং সরকারকে বায়ুমান ও জ্বালানির উন্নয়নে নির্ধারিত আইন প্রয়োগে সহযোগিতা করতে হবে।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর গবেষক ইঞ্জি. মারজিয়াত রহমান, পরিবেশ উদ্যোগ এর গবেষণা সমন্বয়ক ইঞ্জি. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী, বারসিক এর প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুজ্জামান সাগর, একশন এইড এর আবুল কালাম আজাদ, বিএনসিএ এর সদস্য সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর) এর দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রফেশনাল মুমতাহিনা রহমান, সিজিইডি এর প্রেসিডেন্ট সরদার আলী বিশ্বাস, নোঙর ট্রাস্ট এর নির্বাহী পরিচালক ফজলে সানি এবং সেইভ ফিউচার বাংলাদেশ এর প্রধান সমন্বয়ক নয়ন সরকার। এছাড়াও ক্যাপস গবেষণা সহকারী ও বিআইপি এর প্রতিনিধিগণ সহ অন্যান্য পরিবেশবাদী সংস্থার সদস্যবৃন্দ।