ফসলি জমি নষ্ট করে হাওরের বুকে সড়ক
হাওরে এখন বোরো ধানের সমারোহ। শ্রমে-ঘামে ফলানো সোনার ধান বৈশাখে গোলায় তুলবেন কৃষক। লাখো মানুষের জীবন-জীবিকার এই হাওরের বুক চিরে সড়ক নির্মাণের কর্মযজ্ঞ চলছে।
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার সাংহাই হাওরে চার কিলোমিটার লম্বা সড়কের জন্য জমির ক্ষতিপূরণ দূরে থাক, ধান নষ্টের বিষয়েও কৃষকদের কেউ বলার প্রয়োজন মনে করছেন না।
কৃষক ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, হাওরের মাঝখান দিয়ে এভাবে সড়ক হওয়ায় প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির ক্ষতি হচ্ছে। এতে বর্ষায় স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। উজানে দেখা দেবে জলাবদ্ধতা। হাওরের সর্বনাশা এই কাণ্ড ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনে।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ প্রকল্পে সাংহাই হাওরে সড়কের কাজ হচ্ছে। সড়ক নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৪ কোটি টাকা। অর্থায়ন করছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
ঢাকার জেবি ইনোভেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি বাস্তবায়ন করছে। গত বছর কাজ শুরুর পর পানি চলে আসায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কাজ। চলতি বছর কয়েক দিন ধরে কয়েকটি খননযন্ত্র দিয়ে ফসলি জমিতে মাটি কাটা শুরু হয়েছে।
পূর্ব পাড়ের ডুংরিয়া গ্রাম থেকে হাওরের মাঝখান দিয়ে সড়কটি যাবে পশ্চিম পাড়ের হাসনাবাদ গ্রামে। প্রকল্পটি সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের একান্ত ইচ্ছায় নেওয়া।
ডুংরিয়া এম এ মান্নানের নিজ গ্রাম। হাওরের এ অংশে ডুংরিয়া, হাসনাবাদ, জামলাবাজ গ্রামের কৃষকদের জমি। উত্তরে উজানীগাঁও, মির্জাপুর, ফতেপুর গ্রামের কৃষকদের জমি।
জমিতে লাগানো ধানের চারা নষ্ট করে এখন মাটি কাটা হচ্ছে। খননযন্ত্র দিয়ে জমি থেকে মাটি তুলে আবার জমিতেই রাস্তার জন্য ফেলে উঁচু করা হচ্ছে। সড়ক ও দুই পাশে মাটি তুলে খালের মতো করায় প্রস্থে ১০০ ফুটের মতো করে ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে।
স্থানীয় কৃষক তারিফ মিয়ার সাংহাই হাওরে প্রায় ৪ একর জমি আছে। সড়ক ও মাটি কেটে পাশে খাল করায় এক একরের বেশি জমি নষ্ট হয়েছে তাঁর।
তিনি বলেন, ‘সড়ক বানাইবার আগে আমরারে কুনতা জিগাইছে না। এখনো কেউ কুনতা কয় না। আমরার জমি শেষ, ধানও শেষ।’
আরেক কৃষক সেলিম মিয়া বলেন, ‘হাওরের এই জমির ওপর আমরা নির্ভরশীল। একে তো সড়কের নিচে জমি যাচ্ছে। আবার মাটি কেটে আরও জমি নষ্ট করা হচ্ছে।’
মাটি কাটার কাজ তদারক করা আশরাফ উদ্দিন জানান, তাঁরা চারজন মিলে ঠিকাদারের কাছ থেকে এই কাজ করছেন। কৃষকদের ধানের ক্ষতিপূরণ দিতে একটি তালিকা করা হয়েছে।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি প্রকৌশলী মুরাদ আহমদ সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ না করে ফসলি জমির মাটি নেওয়ার বিষয়ে বলেন, ‘মান্নান স্যার কৃষকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সব ব্যবস্থা করেছেন।’
প্রকল্পের আগে জাইকা নিশ্চয় বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করেছে জানিয়ে শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বলেন, কারও কোনো অভিযোগ পেলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবেন। তিনি নিজেও হাওরে সড়ক নির্মাণের কাজ একদিন দেখে এসেছেন বলে জানান।
এ বিষয়ে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, কিশোরগঞ্জে হাওরের এক সড়ক নিয়ে সারা দেশে সমালোচনা হচ্ছে।
সুনামগঞ্জের হাওরে এমন সড়ক হলে হাওরের জীববৈচিত্র্য, কৃষি ও কৃষকের সর্বনাশ হয়ে যাবে। এই হাওর রক্ষায় তাঁরা পরিবেশ উপদেষ্টা ও জেলা প্রশাসনের দ্রুত হস্তক্ষেপ চান।