বর্তমানে ঢাকা শহরে মাত্র ১৬২ প্রজাতির পাখি টিকে আছে
পাঁচ দশক আগে রাজধানী ঢাকা শহর ছিল জলা, বনজঙ্গল আর তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। শহরের বর্তমান ব্যস্ত এলাকাগুলোতেও তখন অবাধ বিচরণ ছিল পাখিসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর।
কিন্তু ইট-কাঠ আর জঞ্জালের স্তূপ হয়ে ওঠায় অনেক বন্য প্রাণী ঢাকা থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ঢাকা শহরে ১৬২ প্রজাতির পাখি এখনো টিকে আছে। এ ছাড়া প্রতিবছর ৪০টির বেশি প্রজাতির অতিথি পাখি আসে এই শহরে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের এক দশকের গবেষণায় এসব পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরির অধীনে ২০১৩ সাল থেকে এই গবেষণা চলছে।
গবেষক দলে আছেন বিভাগটির অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান, সহকারী অধ্যাপক মো. মাহবুব আলম, প্রভাষক মো. ফজলে রাব্বি এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থী, বন্য প্রাণী গবেষক ও পরিবেশবিদ আশিকুর রহমান।
মঙ্গলবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত পাখিমেলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ রিসার্চ ল্যাবরেটরির পক্ষ থেকে ‘আমাদের শহরের পাখিরা’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি বুকলেটে গবেষণার তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
বুকলেটে বলা হয়, ‘৫০ বছর আগেও ঢাকা ছিল আবাসস্থল, অফিস, দোকান আর রাস্তার চেয়ে জলা, বনজঙ্গল ও তৃণভূমির সমন্বয়ে গঠিত এক অপূর্ব ক্যানভাস। বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, তখনো ঢাকার বর্তমান ব্যস্ত এলাকাগুলোয় আনাগোনা ও অবাধ বিচরণ ছিল বন্য প্রাণীদের। কাঁটাবন থেকেও শিয়ালের ডাক শোনা যেত।
একসময়কার দেশি ময়ূর, লাল বনমোরগ, মেটে তিতির, কালো তিতিরের সেই বিচরণক্ষেত্র পরিণত হয়েছে ইট-কাঠ আর জঞ্জালের স্তূপে। বন্য প্রাণীরা হয়েছে ঢাকা থেকে বিলুপ্ত। বুনো হাঁস আর সারসদের জলাশয়গুলো প্রাণ হারিয়ে পচা ডোবা আর বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক ব্যাধির মূল উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
প্রকৃতি ধ্বংস করে মানুষ নিজেই তৈরি করেছে তার মৃত্যুকফিন। প্রকৃতি হারিয়ে ফেলছে তার ভারসাম্য। এত কিছুর পরও এখন ঢাকা শহরে টিকে আছে ১৬২ প্রজাতির পাখি।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরে বন্য প্রাণীর ওপর আমাদের করা বিস্তারিত গবেষণায় এ তথ্য জানা গেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, রমনা, জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান, উত্তরা, দিয়াবাড়ী, আফতাবনগর, গুলশান-বনানী লেকের আশপাশের এলাকা ঢাকা শহরে পাখির হটস্পট।’
ঢাকা শহরের বিভিন্ন তৃণভূমিতে এখনো ছয় প্রজাতির মুনিয়া ও চার প্রজাতির টিয়া পাখির দেখা মেলে বলে বুকলেটে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, গোলাপি সহেলি, সুইনহোস সহেলি, কেশরী ফিঙে, ছোট ভীমরাজের দেখা মেলে ঢাকার উদ্ভিদ উদ্যানেই। বছরে ৪০ প্রজাতির অধিক অতিথি পাখি আসে এই ঢাকা শহরে।
মাছমুরাল, বিভিন্ন প্রজাতির খঞ্জন, জিরিয়া বাটান, চ্যাগা, ছোট কান প্যাঁচা, আঁশটে দামা, ব্লু থ্রোট, রুবিথ্রোট, লাল গির্দিসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুটকি ও চুটকিজাতীয় পাখি রয়েছে।
আমুর ফ্যালকন, কয়েক প্রজাতির ইগল, বাজার্ড, চিল, প্যাঁচাসহ দেখা মেলে বিভিন্ন শিকারি পাখির। কিন্তু এগুলোর সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমেই কমে যাচ্ছে। কারণ, এই পাখিরা হারাচ্ছে তাদের আবাসস্থল, ক্রমেই নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বুকলেটে আরো বলা হয়, তুলনামূলক অবস্থান খেয়াল করলে দেখা যায়, ঢাকা শহরে পাখি প্রজাতির মধ্যে অসম বিন্যাস পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ কিছু নির্দিষ্ট প্রজাতির পাখির সংখ্যা এখানে খুবই বেশি।
অন্যদিকে ঢাকার বাইরের জেলা শহরগুলোয় পাখিদের মধ্যে খুব বেশি অসম বিন্যাস পরিলক্ষিত হয় না। কারণ, সেখানে এখনো সবুজ এলাকা টিকে আছে, আছে দেশজ বুনো গাছপালার প্রাচুর্য, আছে বাসস্থানের নিরাপত্তাও।
কিন্তু ওই এলাকাগুলোয় অবৈধ শিকারের হার ঢাকার তুলনায় বেশি। কারণ, অনেক মানুষ এখনো পাখি শিকার বন্ধে সচেতন নয়।
শহরের পাখিদের সংরক্ষণে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বুকলেটে। এতে বলা হয়েছে, শুধু পাখিদের স্বার্থে নয়, মানুষের স্বার্থেও পাখি সংরক্ষণ করতে হবে। নগর পরিকল্পনায় তাদের জন্য স্থান রাখতে হবে।
জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের মতো করে শহরে প্রয়োজন কিছু পার্ক, যেখানে থাকবে প্রাকৃতিক পরিবেশ, থাকবে দেশি বুনো গাছপালার সমাহার, যেখানে বন্য প্রাণীরা থাকবে নিরাপদে, হবে পাখির কলকাকলিতে মুখর৷ শুধু গাছপালা নয়, দেশি লতাগুল্মসমৃদ্ধ ঝোপঝাড়ের দিকেও নজর দিতে হবে।
গবেষক দলে থাকা প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক মোহাম্মদ ফিরোজ জামান বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে আমরা এই গবেষণার কাজ করছি। এখনো কাজ চলমান। ইতিমধ্যে আমরা কিছু পাবলিকেশনও করেছি।
ঢাকা ও নগরাঞ্চল মিলিয়ে আমরা ১৮০ প্রজাতির পাখির তথ্য পেয়েছি। অন্য প্রাণীও বেশ কিছু পাওয়া গেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বেনবেইস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং ইউজিসি এই গবেষণায় অর্থায়ন করেছে।’