বাংলাদেশে ইটভাটা দূষণ মোকাবিলায় টেকসই সমাধান উদ্ভাবন
বাংলাদেশ ইটভাটা থেকে সৃষ্ট দূষণ হ্রাসে একটি নতুন ও উদ্ভাবনী পদ্ধতির বিকাশ ঘটিয়েছে, যা দেশের বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান উৎস। একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় সমর্থিত এই উদ্যোগে কার্বন নির্গমন ২০% কমানো এবং জ্বালানির ব্যবহার ২৩% হ্রাসের সম্ভাবনা রয়েছে, যেখানে পরিবেশ ও সামাজিক সুবিধাগুলো ব্যয় অপেক্ষা ৬৫ গুণ বেশি লাভজনক। গবেষণাটি ২০২৫ সালের মে মাসে Science জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রযুক্তি সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া
icddr,b এর নেতৃত্বে, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রিনটেক নলেজ সলিউশনস, বুয়েট এবং বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল অব পাবলিক হেলথ-এর সহযোগিতায় পরিচালিত এই গবেষণায় ২০২২-২৩ উৎপাদন মৌসুমে খুলনা বিভাগের ২৭৬টি ইটভাটা মালিক অংশগ্রহণ করেন। প্রযুক্তিভিত্তিক হস্তক্ষেপগুলো অন্তর্ভুক্ত করেছে:
- অনুকূল স্তূপীকরণ পদ্ধতি: ইট সাজানোর পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে বাতাস চলাচল উন্নত করা এবং জ্বালানি সাশ্রয়।
- জৈবজ্বালানির সংযোজন: কয়লার পাশাপাশি করাতের গুঁড়া ও ধানের খোসার মতো বায়োমাস ব্যবহার করে সম্পূর্ণ দহন নিশ্চিতকরণ এবং তাপ অপচয় কমানো।
- তাপ ধারণের উন্নতি: ভাটা চেম্বার সিল করে তাপের অপচয় রোধ এবং স্থিতিশীল তাপমাত্রা বজায় রাখা, যার ফলে কয়লার ব্যবহার হ্রাস পায়।
- অবিরাম কয়লা খাওয়ানো: নিয়মিত কয়লা খাওয়ানোর মাধ্যমে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি।
icddr,b-এর পরিবেশ স্বাস্থ্য ও ওয়াশ বিভাগের প্রধান মাহবুবুর রহমান বলেন, “আমাদের পদ্ধতিগুলো সহজলভ্য ও স্বল্পব্যয়ী, যা জটিল যন্ত্রপাতি ছাড়াই প্রয়োগযোগ্য। জ্বালানি খাওয়ানো ও বায়ুপ্রবাহ ব্যবস্থাপনায় সামান্য পরিবর্তনেই দূষণ ও খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।”
পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক প্রভাব
বাংলাদেশের প্রায় ৭,০০০টি ইটভাটার অর্ধেকই অনুমতি ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে, যা বড় শহরগুলোতে, বিশেষ করে ঢাকায়, বায়ু দূষণের অন্যতম উৎস। সেন্টার ফর অ্যাটমোসফেরিক পলিউশন স্টাডিজ (CAPS)-এর চেয়ারম্যান আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, এই ভাটাগুলোর প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক।
গবেষণায় দেখা যায়, ৬৫% ইটভাটা মালিক নতুন পদ্ধতিগুলো গ্রহণ করেছেন, যার ফলে ২৩% জ্বালানি সাশ্রয় ও ২০% CO₂ ও PM2.5 নির্গমন হ্রাস পেয়েছে। প্রতি টন CO₂ কমাতে ব্যয় হয়েছে $2.85, যেখানে নিষ্ক্রিয়তার সামাজিক ও পরিবেশগত ব্যয় প্রতি টনে $185। তবে এই $185 মূল্যের ভিত্তি—যেমন স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ক্ষতির বিবরণ—আরও ব্যাখ্যার প্রয়োজন।
নীতিগত সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ প্রভাব
যদিও প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপের ফলাফল আশাব্যঞ্জক, কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োগ অপরিহার্য। সরকারের বিদ্যমান নীতিমালায় কাঠের জ্বালানির ব্যবহার নিষিদ্ধ ও স্কুল ও হাসপাতালের আশপাশ থেকে ইটভাটা অপসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়ে গেছে। পরিবেশবাদী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, ইট তৈরিতে টপসয়েলের ব্যাপক ব্যবহার কৃষি উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে, তাই কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও টেকসই বিকল্প প্রয়োজন।
চ্যালেঞ্জ ও সুপারিশ
এতসব ইতিবাচক ফলাফলের পরও, মালিকদের অনেকেই খরচ ও উৎপাদনে বিঘ্নের আশঙ্কায় নতুন পদ্ধতি গ্রহণে দ্বিধাগ্রস্ত। পাশাপাশি, টপসয়েল ব্যবহারের ফলে কৃষি জমির অবক্ষয় অব্যাহত রয়েছে।
গবেষণার সহ-লেখক দেবাশীষ বিশ্বাস বলেন, “ছোট ছোট পরিবর্তন বড় প্রভাব ফেলতে পারে, তবে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতার জন্য নিয়ন্ত্রক সহায়তা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।” ভবিষ্যতের উদ্যোগে মাটির বিকল্প খোঁজা এবং টেকসই ইট তৈরির পদ্ধতি প্রচারের ওপর জোর দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
উপসংহার ও কার্যকর আহ্বান
এই গবেষণার মাধ্যমে পরিবেশগত নিয়ন্ত্রণ বাস্তবায়ন, পরিচ্ছন্ন উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রণোদনা এবং প্রযুক্তি গ্রহণে আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়েছে। এ পদ্ধতিগুলো বিস্তৃতভাবে বাস্তবায়ন করা হলে বছরে ২৪ লাখ টন CO₂ নির্গমন হ্রাস পেতে পারে, যা জাতীয় কার্বন নির্গমনের ২% কমাতে সহায়ক। বাংলাদেশকে তার কার্বন হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিয়ন্ত্রক কঠোরতা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং সম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রয়োগ প্রয়োজন।