ভারতের দূষিত পানিতে নষ্ট হচ্ছে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের কালন্দি খাল দিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বয়ে আসা ময়লা ও বিষাক্ত দুর্গন্ধযুক্ত কালো পানি ঢুকছে বাংলাদেশে। এতে নষ্ট হচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ।
এ পানি নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে সমস্যাটির সমাধান হচ্ছে না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের কৃষকসহ সাধারণ নাগরিক।
তবে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক সমস্যা আখ্যায়িত করে সমাধানের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।
ভারতীয় পানি আসার উৎপত্তিস্থল আখাউড়া স্থলবন্দরে দেখা যায়, উত্তর পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার কলকারখানা, বসতবাড়ি ও হাসপাতালের উচ্ছিষ্ট, ময়লা-আবর্জনা মিশ্রিত পানি আখাউড়া সীমান্তবর্তী ধলেশ্বর, বঙ্গেরচর, আব্দুল্লাপুর, গাজীরবাজার, উমেদনগর, নারায়ণপুর ও আখাউড়া পৌর এলাকার বড়বাজার হয়ে তিতাস নদীতে ঢুকছে। এতে জীববৈচিত্র্য অনেকটা হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানীয় কৃষক খুরশিদ মিয়া জানান, গত পাঁচ দশকের ব্যবধানে পানি দূষণের মাত্রা বেড়েছে কয়েকগুণ। আখাউড়া উপজেলার সীমান্তবর্তী ১৫টি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষক, জমিতে সেচের জন্যে এই কালন্দি ও জাজিগাঙ নামে দুটি খালের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু ভারতীয় ময়লা দূষিত পানি দুটি খালেই ছড়িয়ে গেছে। এছাড়া সেচের জন্যে তাদের কাছে বিকল্প পথ খোলা না থাকায়, দূষিত পানি দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে।
কৃষক খুরশিদ আরো জানান, এই পানি শরীরে লাগলে শুরু হয় চুলকানি। দীর্ঘক্ষণ এই পানিতে থাকলে খোসপাঁচড়াসহ চর্মরোগ দেখা দেয়।
আখাউড়া স্থলবন্দরে ব্যবসায়ী ও সীমান্তবর্তী গ্রামের বাসিন্দা রাকিব আহমেদ বলেন, ‘আগরতলা থেকে কালন্দি খাল দিয়ে যে বিষাক্ত পানি আসছে, এই পানি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকির। তাছাড়া এই পানি দিয়ে জমিতে চাষাবাদ করা হচ্ছে, যেসব ফসল উৎপাদন হচ্ছে, এগুলো আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা সব সময় বলে এসেছি, পানি পরিশুদ্ধ করে যেন পাঠানো হয়। তারাও আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার কোনো সুফল পাইনি আমরা। আমাদের দাবি এই পানি পরিশুদ্ধ হয়ে যেন আমাদের দেশের ভেতরে আসে।’
সীমান্তবর্তী নারায়ণপুর গ্রামের বাসিন্দা হোসেন বলেন, ‘আমরা অনেকবার শুনেছি যে, ভারত সরকার এই পানি পরিশুদ্ধ করে পাঠাবে। কিন্তু বার-বার বলার পরও এই বিষাক্ত পানিই আমাদের দেশে আসছে।
এই পানি জমিতে চাষ করে কৃষকরাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। এতে স্থানীয় কৃষকেরা চর্মরোগসহ নানা অজানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। আমরা দাবি জানাই, ভারত সরকার যেন এই পানির ব্যাপারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।’
আখাউড়া পরিবেশ ক্লাবের আহ্বায়ক রুবেল বলেন, ‘আগরতলার শিল্পবর্জ্য ও হাসপাতালের বর্জ্য খালন্দি খাল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। এই পানি সর্বশেষ আমাদের তিতাস নদীতে গিয়ে মিলিত হচ্ছে।
এতে করে আমাদের মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যে অনেক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। তা ছাড়া এই সীমান্ত অঞ্চলের প্রায় ১৫টি গ্রামের কৃষক এই পানির ওপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করছে। আমাদের খাদ্য উৎপাদন হচ্ছে এই বিষাক্ত পানি দিয়ে।
এই খাদ্য গ্রহণে মানবদেহে অনেক রোগবালাই সৃষ্টি হচ্ছে। এই বিষাক্ত পানিকে পরিশুদ্ধ করে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন মেনে স্বচ্ছ পানির বিষয়ে আমাদের দাবি রয়েছে। আমরা আশা করবো অতিদ্রুত যেন দাবি বাস্তবায়ন করা হয়।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘এই পানির বিষয়ে শুধু জাতীয় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনারের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে।
তারা বলেছে, ইটিপি (অপরিশোধিত পানিকে পরিশোধিত করা) এইচটিপি (উচ্চ-পরীক্ষা পারক্সাইড) করছে। কিন্তু পানির যে পরিমাণ দূষণ তাতে সেটা হচ্ছে না।
আমি জেলা প্রশাসক সম্মেলনে এই প্রস্তাবটি তুলেছি। এ বিষয়ে আমাদের উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টা অবগত আছেন। আমাদের দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে আমরা পরিবেশ অধিদফতরে জানিয়েছি। তারা এটা পরীক্ষা করে বিষাক্ততার মাত্রাও পেয়েছে। আমরা ভারতকে জানিয়েছি। তারা বলছে, তারা এইচটিপি লাগিয়েছে। আমরা এইচটিপি নয় ইটিপি করার জন্য চেষ্টা করছি।’
বিষাক্ত পানি প্রবাহিত হওয়া কালন্দি খালটি আখাউড়া উত্তর-দক্ষিণ ইউনিয়ন এবং পৌর এলাকার অন্তত ৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বড়বাজার এলাকা দিয়ে তিতাস নদীতে প্রবাহিত হয়।