মাত্র ১ শতাংশ ধনীর কারণে সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়েছে পৃথিবী
– আন্তর্জাতিক ডেস্ক | Green Page
বিশ্বের জলবায়ু সংকটের মূল কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, শিল্পায়ন এবং রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার কথা বলা হয়। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে এক গভীরতর এবং সামাজিকভাবে অস্বস্তিকর সত্য—পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষই পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস।
ব্রিটিশ অলাভজনক সংস্থা অক্সফাম ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর প্রকাশিত এক গবেষণায় জানিয়েছে, ২০১৯ সালে এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী বিশ্বের সর্বোচ্চ মাত্রায় কার্বন নিঃসরণ করেছে।
সংখ্যায় এই ধনী জনগোষ্ঠী প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ হলেও, তাদের জীবনযাপন এবং বিনিয়োগ কার্যক্রম বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে নাটকীয়ভাবে ত্বরান্বিত করেছে।
ওক্সফামের গবেষণায় দেখা যায়, এই ১ শতাংশ ধনীর কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র ৬৬ শতাংশ মানুষের সম্মিলিত নিঃসরণের চেয়েও বেশি।
এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়; এটি এক ধরনের জলবায়ু নিপীড়ন, যা ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর ভোগবাদী জীবনের কারণে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছিল, তার একটি বড় অংশ এসেছে শুধুমাত্র এই অতি ধনীদের জীবনধারা ও বিনিয়োগ থেকে। এমনকি, ওই বছর বিশ্বজুড়ে সব যানবাহন যেই পরিমাণ নিঃসরণ করেছিল, তার চেয়েও বেশি নিঃসরণ ঘটেছে এই শ্রেণির কারণে।
ধনীদের জীবনযাপন যে পরিমাণ দূষণ ঘটায়, তা কেবলমাত্র তাদের বিলাসবহুল পণ্য ব্যবহার বা ব্যক্তিগত বিমানে ভ্রমণেই সীমাবদ্ধ নয়। তাদের শিল্প-ভিত্তিক বিনিয়োগ, ফসিল জ্বালানিনির্ভর ব্যবসা এবং উচ্চভোগবাদী প্রবণতা প্রকৃতির ওপর এক ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করে।
এই চাপ থেকে মুক্তি পেতে গেলে শুধুমাত্র গরিব জনগণকে সচেতন হওয়া বা তাদের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করাই যথেষ্ট নয়—প্রয়োজন রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী এবং সম্পদবান শ্রেণির উপর কাঠামোগত ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।
২০১৫ সালের প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে বৈশ্বিক নেতারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, শিল্পপূর্ব যুগের তাপমাত্রার তুলনায় বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে।
অথচ ২০২৩ সালের নভেম্বরে সেই তাপমাত্রা ২ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে, যা সরাসরি সেই প্রতিশ্রুতির ব্যর্থতা নির্দেশ করে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব আফ্রিকা ও অন্যান্য অঞ্চলের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এখন প্রায়শই খরা, বন্যা, খাদ্য সংকট ও স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।
এই সংকটের প্রেক্ষাপটে, অক্সফাম বিশেষায়িত জলবায়ু কর ব্যবস্থার প্রস্তাব দিয়েছে। সংস্থাটির মতে, বিশ্বের ১ শতাংশ অতি ধনীর আয় থেকে যদি ৬০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়, তাহলে বছরে প্রায় ৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলার রাজস্ব অর্জন করা সম্ভব।
এই অর্থ দিয়ে জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বিশ্বকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে সরিয়ে নেওয়া যাবে, যা একাধারে টেকসই উন্নয়ন এবং জলবায়ু সুবিচারের পথ প্রশস্ত করবে।
পরিবেশ সুরক্ষায় সচেতনতা অবশ্যই জরুরি, তবে সেটি কেবলমাত্র মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগণের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে কার্যকর হবে না। ধনী দেশ ও ধনী ব্যক্তিদেরকে তাদের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করাও এখন সময়ের দাবি।
তাদের ভোগবিলাস আর মুনাফাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা পরিবর্তন না হলে, বিশ্বের সবচেয়ে বিপন্ন জনগোষ্ঠীকে এই দুর্বিষহ উষ্ণ ভবিষ্যতের দায় বইতেই হবে।
পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ মানুষের জীবন ও ভবিষ্যৎ যেন ১ শতাংশ ধনীর অবাধ ভোগের বলি না হয়—এই ন্যায্যতা ও পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় এখনই সময় পদক্ষেপ নেওয়ার। বিশ্বকে রক্ষা করতে হলে শুধু পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নয়, প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব নীতি ও শ্রেণিগত ন্যায্যতা।
Green Page প্রতিবেদক | পরিবেশ সচেতনতার জন্য নিবেদিত
