23 C
ঢাকা, বাংলাদেশ
সকাল ৯:৪৫ | ১২ই মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ বঙ্গাব্দ
গ্রীন পেইজ
মানুষের ভিড়ে বাইক্কা বিলে এখন আর শোনা যায় না অতিথি পাখির কিচিরমিচির
জীববৈচিত্র্য

মানুষের ভিড়ে বাইক্কা বিলে এখন আর শোনা যায় না অতিথি পাখির কিচিরমিচির

মানুষের ভিড়ে বাইক্কা বিলে এখন আর শোনা যায় না অতিথি পাখির কিচিরমিচির

মৌলভীবাজার জেলা সদর, শ্রীমঙ্গল উপজেলা ও হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে হাইল হাওর। আর এই হাওরের একটা বিলের নাম বাইক্কা বিল। বাইক্কা বিলের নাম শুনলেই হাজারো পাখির মেলা ভেসে ওঠে এই অঞ্চলের মানুষের চোখে।

একসময় শীত এলেই ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির দেখা মিলত বাইক্কা বিলে। শত প্রজাতির হাজারো অতিথি পাখির কিচিরমিচিরে মুখরিত থাকত বিল এলাকা। বিভিন্ন প্রজাতির দেশি পাখির নিরাপদ আবাসস্থল ছিল এই বিল।

কয়েক বছর ধরে আর এই রূপ দেখা যায় না। শীতেও অতিথি পাখির আগমন কমে গিয়েছে। দেশি পাখির আনাগোনাও তেমন দেখা যায় না। পাখিদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে এই আবাসস্থল।

কয়েক বছর ধরে অতিথি পাখির সংখ্যা কমে আসার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবাসস্থল কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জলজ উদ্ভিদ কমে যাওয়া। পাখিদের বসবাসের জন্য বাইক্কা বিলের পরিবেশগত উপযোগিতা কমে গিয়েছে।

২০০৩ সালের ১ জুলাই বিলের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১০০ হেক্টর জলাভূমিকে ‘বাইক্কা বিল অভয়াশ্রম’ ঘোষণা করে ভূমি মন্ত্রণালয়। মাছ ধরা ও জলজ উদ্ভিদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়। এই বিলে বালিহাঁস, উত্তরে লেঞ্জা হাঁস, গিরিয়া হাঁস, উত্তরে খন্তিহাঁস, মরচে রং ভূতিহাঁস, মেটে মাথা টিটি, কালালেজ জৌরালি, খয়রা কাস্তে চরা, তিলা লালসা, গেওয়ালা বাটান, পিয়াং হাঁস, পাতি তিলা হাঁস, নীলমাথা হাঁস, বিল বাটান, পাতিসবুজলা, বন বাটান, পাতিচ্যাগা, ছোট ডুবুরি, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি, গয়ার, বাংলা শকুন, এশীয় শামুকখোল, পানমুরগি, পাতিকুট, নিউপিপি, দলপিপি, কালাপাখ ঠেঙ্গি, উদয়ী বাবু বাটান, ছোট নথ জিরিয়া, রাজহাঁস, ওটা, ধুপনি বক, ইগল, ভুবন চিল, হলদে বক, দেশি কানিবক, গোবক, ছোট বক, মাঝেলা বগা, লালচে বক, বেগুনি কালেম, বড় বগা, দেশি মেটে হাঁস, সরালি, বালিহাঁস, পানমুরগিসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যেত।

এ ছাড়া বিলের পাড়ে গাছগাছালিতে শালিক, ঘুঘু, দোয়েল, চড়ুই, বুলবুলি, দাগি ঘাস পাখি, টুনটুনিসহ বিভিন্ন ধরনের দেশি পাখির বসবাস ছিল।

বাইক্কা বিলে প্রতিবছর একটি বেসরকারি একটা সংস্থা পাখি শুমারি করে। তারা বলছে, গত কয়েক বছর ধরে পাখির সংখ্যা কমেছে। তাদের শুমারিতে ২০২৪ সালে ৩৮ প্রজাতির ৭ হাজার ৭৮০ পাখির সংখ্যা পাওয়া গেছে। ২০২৩ সালে ৩৩ প্রজাতির ৪ হাজার ৬১৫ পাখি ছিল। এর আগে শুমারিতে ১২ হাজার পর্যন্ত পাখির হিসাব পাওয়া গিয়েছিল।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, যাঁরা বাইক্কা বিল দেখাশোনা করেন, তাঁরাই পাখি ও মাছ শিকারে জড়িত। বন্যার সময় মাছ শিকার করতে সব কচুরিপানা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কচুরিপানা, শাপলা-শালুক না থাকায় খাবারের অভাবে পাখি কমে যাচ্ছে। এ ছাড়া নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল দিয়ে পাখি ও মাছ শিকার, হাওর বাঁধ, সেচ মেশিন ব্যবহারের কারণে পাখি কমে যাচ্ছে।

পাখি কমে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বাইক্কা বিলের দায়িত্বে থাকা বড়গাঙ্গিনা সম্পদ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মিন্নত আলী বলেন, এক দশক আগে পাখির সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। তবে কয়েক বছর ধরে পাখির সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে আসছে।

পাখি গবেষকেরা বলছেন, মাছ শিকারের জন্য বিল থেকে জলজ উদ্ভিদ সরিয়ে ফেলা হয়েছে। কচুরিপানা, শাপলা-শালুক না থাকায় পাখিরা কোথাও বসে খাবার খেতে পারে না। পাখি না আসার মূল কারণ এটি। এ ছাড়া ফাঁদ পেতে পাখি শিকার নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা ও জলজ উদ্ভিদের অভাব পাখিদের বিলে আসা কমিয়ে দিচ্ছে।

পানির পাশাপাশি হাওর এলাকায় গাছগাছালি কমে যাওয়া, অপরিকল্পিতভাবে হাওর ভরাট, সেচ ও বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে মাছ ধরা, নির্বিচারে পাখি শিকার, হাওরের ভেতর দিয়ে যানবাহন চলাচল, শীত কমে যাওয়া, আবাসস্থল ধ্বংসের পেছনে আবহাওয়া বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ নানা কারণে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা এখন থেকে সচেতন না হলে বাইক্কা বিল থেকে পাখিরা একেবারে চলে যাবে বলে সতর্ক করছেন পরিবেশবিদেরা।

পরিবেশকর্মী নূরুল মোহাইমিন মিল্টন বলেন, বাইক্কা বিলে কয়েক বছর ধরে শীতে অতিথি পাখি কম আসার মূল কারণ জলজ ও স্থলজ পরিবেশের অবক্ষয়।

আবহাওয়ার পরিবর্তন, পাখির নিরাপদ আবাসস্থল না থাকা, খাবার সংগ্রহে ঝুঁকি, পুঁজিবাদী ভোগ বিলাসিতার কারণে হাওর-বিল ভরাট, বেদখল আর বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এসব কারণ থেকে বাইক্কা বিল রক্ষা করলে পাখির সংখ্যা বাড়ার আশা করা যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যানের প্রণেতা অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ মনিরুল হাসান খান বলেন, বাইক্কা বিলকে সংরক্ষিত বিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই বিল পাখি ও মা মাছের জন্য সংরক্ষণ করা হয়েছে।

এখন যদি সেই আগের মতো পাখি বা মৎস্য নিধন করা হয় অথবা জলজ উদ্ভিদ ফেলে দেওয়া হয় তাহলে পাখি বা মাছ কারও জন্য ভালো হবে না। পাখিদের ফিরিয়ে আনতে বিল সংরক্ষণ করতে হবে। পরিবেশের পাশাপাশি পাখিদের জন্য জলজ উদ্ভিদ বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী ও বন্য প্রাণী গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমান বলেন, বাইক্কা বিলের পরিবেশ, জলজ উদ্ভিদ কমে যাওয়া, অবাধে পাখি শিকার, অতিরিক্ত পর্যটক, বৃক্ষনিধন, যে জায়গায় পাখিরা থাকে সেখান থেকে মাছ শিকার এসব কারণে পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাখি অবাধ বিচরণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো একটা সময় এখানে আর পাখি পাওয়া যাবে না।

পাখি কমে যাওয়ার বিষয়ে মৌলভীবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘সংরক্ষিত বাইক্কা বিলে নিরাপদে পাখিরা আশ্রয় নেওয়ার জন্য আমরা সব সময় নিরাপত্তার জন্য মানুষ নিয়োগ দিয়েছি।

এ ছাড়া কেউ যদি অবৈধভাবে পাখি বা মাছ শিকার করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযান পরিচালনা করি। পাখি কমার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে আবহাওয়া। আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় পাখিরা কম আসছে।’

বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ, সিলেটের (সদর দপ্তর মৌলভীবাজার) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাইক্কা বিলে পাখির সংখ্যা কমার পেছনে নানা কারণ রয়েছে।

হাওরের গভীরতা আগের চেয়ে অনেক কমেছে, যেখানে আগে আট থেকে নয় মাস হাওরে পানি থাকত, এখন সেখানে তিন থেকে চার মাস পানি থাকে।

এ ছাড়া শীতের তীব্রতা আগের মতো নেই। শীত কম থাকায় হয়তো অতিথি পাখিরা আসা কমিয়ে দিয়েছে। আগের চেয়ে মানুষজন আসা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এসব কারণে হয়তো পাখিরা আসা কমিয়ে দিচ্ছে।’

“Green Page” কে সহযোগিতার আহ্বান

সম্পর্কিত পোস্ট

Green Page | Only One Environment News Portal in Bangladesh
Bangladeshi News, International News, Environmental News, Bangla News, Latest News, Special News, Sports News, All Bangladesh Local News and Every Situation of the world are available in this Bangla News Website.

এই ওয়েবসাইটটি আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করে। আমরা ধরে নিচ্ছি যে আপনি এটির সাথে ঠিক আছেন, তবে আপনি ইচ্ছা করলেই স্কিপ করতে পারেন। গ্রহন বিস্তারিত