শকুনের নিরাপদ আশ্রয়: বাংলাদেশের অনন্য “রেস্তোরাঁ” বিলুপ্তির পথে থাকা পাখিকে টিকিয়ে রাখছে
GreenPage রিপোর্ট
হবিগঞ্জের রেমা–কালেঙ্গা বনের ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে ১৩টি শকুন ভিড় জমায় এক অদ্ভুত খাবারের জায়গায়। এটি কোনো সাধারণ জায়গা নয়—এটি একটি “শকুন রেস্তোরাঁ,” যেখানে ওষুধমুক্ত গরুর মৃতদেহ ফেলে রাখা হয়, যাতে শকুনেরা নিরাপদে খাবার পেতে পারে।
বাবা-মা আর ছানাদের একসঙ্গে খাবার খাওয়ার দৃশ্য আজকের দিনে বিরল, তবু এই দৃশ্য প্রমাণ করে শকুন সংরক্ষণের লড়াই এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) এবং বাংলাদেশ বন বিভাগ এই উদ্যোগ চালু করে। প্রথম শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু শকুন রেস্তোরাঁ এখন হয়ে উঠেছে জীবন বাঁচানোর এক গুরুত্বপূর্ণ পন্থা।
মাত্র তিন দশকে দক্ষিণ এশিয়ায় শকুনের সংখ্যা ভয়াবহভাবে কমে গেছে। প্রধান কারণ হলো গবাদিপশুতে ব্যবহৃত ব্যথানাশক ওষুধ—ডাইক্লোফেনাক, কিটোপ্রোফেন ও ফ্লুনিক্সিন। গরু মরে গেলে সেই মৃতদেহে ওষুধ থেকে যায়, আর শকুন তা খেলে কিডনির ব্যর্থতায় মারা পড়ে।
সংকটের গভীরতা ভয়াবহ। যে শকুন একসময় লক্ষ লক্ষ সংখ্যায় আকাশে উড়ত, এখন তার সংখ্যা কয়েকশতে নেমে এসেছে। বাংলাদেশে আজ টিকে আছে সর্বোচ্চ আড়াই শ শকুন, যার বেশির ভাগই সুন্দরবন আর অল্প কয়েকটি দল রেমা–কালেঙ্গার মতো জায়গায়। এই ভঙ্গুর অবস্থায় শকুন রেস্তোরাঁ হয়ে উঠেছে শেষ ভরসা।
এ বছর প্রজনন মৌসুমে রেমা–কালেঙ্গায় ১২টি সক্রিয় বাসা পাওয়া গেছে, এবং একাধিক ছানা সফলভাবে বড় হয়েছে নিরাপদ খাবারের কারণে। যারা সাইটটি পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা বলেন, মা-বাবা আর ছানাদের একসঙ্গে খাবার খাওয়ার পর গাছে উড়ে যাওয়া দৃশ্য সত্যিই অনন্য অভিজ্ঞতা।
বিজ্ঞানীরা বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করেছেন। ইতিমধ্যে ২৭০–এর বেশি গবেষণায় দেখানো হয়েছে এই ওষুধগুলো শকুনের জন্য মারাত্মক। দক্ষিণ এশিয়ায় ডাইক্লোফেনাক নিষিদ্ধ হয়েছে, আর বাংলাদেশে কিটোপ্রোফেনও বন্ধ করা হয়েছে।
তবে বাজারে এখন ফ্লুনিক্সিন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, যা নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। অথচ নিরাপদ বিকল্প মেলেক্সিক্যাম ও টলফেনামিক অ্যাসিড সহজেই পাওয়া যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষতিকর ওষুধের অবাধ ব্যবহার শকুন সংরক্ষণের সাফল্যকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।
তবুও কিছু আশার গল্প রয়েছে। চলতি বছর রেমা–কালেঙ্গায় অসুস্থ একটি ছানাকে উদ্ধার করে কয়েকদিন পরিচর্যার পর আবার প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন সেটি সুস্থভাবে বেঁচে আছে এবং প্রায়ই রেস্তোরাঁয় ফিরে আসে খাবারের জন্য। এ ধরনের ছোট ছোট জয় প্রমাণ করে সঠিক পদক্ষেপ নিলে প্রজাতিটিকে রক্ষা করা সম্ভব।
৬ সেপ্টেম্বর উদ্যাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল—“ক্ষতিকর ওষুধমুক্ত পরিবেশ, শকুন সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি।”
বার্তাটি স্পষ্ট: যদি বাজার থেকে বিষাক্ত ওষুধ সরানো না যায় এবং নিরাপদ অঞ্চল বাড়ানো না হয়, তবে বাংলাদেশ থেকে শকুন বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। অথচ প্রকৃতির এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী শুধু বাস্তুসংস্থান রক্ষায় নয়, রোগবালাই কমাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রেমা–কালেঙ্গার এই রেস্তোরাঁ একই সঙ্গে সতর্কবার্তা ও আশার প্রতীক। এটি দেখায়, মানুষ যখন প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে, একটি প্রজাতি কত দ্রুত হারিয়ে যেতে পারে। আবার এটিও প্রমাণ করে বিজ্ঞানভিত্তিক উদ্ভাবনী উদ্যোগ কিভাবে পুনরুদ্ধারের পথ খুলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের হাতে এখন সুযোগ আছে শকুনকে আকাশে ফিরিয়ে আনার, আর হবিগঞ্জের বনভূমির এই “খাবারের টেবিল” প্রমাণ করছে—ইচ্ছা থাকলে প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদকে বাঁচানো এখনও সম্ভব।