সেন্ট মার্টিন রক্ষায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে পর্যটক
দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন বাঁচাতে পর্যটক যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ ও সেখানে রাতযাপন নিষিদ্ধের দাবিতে বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ। জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের মাধ্যমে এই স্মারকলিপি দেওয়া হয়।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, কক্সবাজারে এখন প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসে লিপ্ত রয়েছেন কিছু স্বার্থান্বেষী ও লোভী ব্যবসায়ী। প্রাকৃতিক নিসর্গের লীলাভূমি দেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ ধ্বংসযজ্ঞে নেমেছেন তাঁরা।
বঙ্গোপসাগরের বুকে জেগে ওঠা ক্ষুদ্র দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। এর আয়তন মাত্র তিন বর্গমাইল, যা কিলোমিটারে ৭ দশমিক ৮ বর্গকিলোমিটার। বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১২ হাজার। রয়েছে দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল।
কোনোটির বৈধ অনুমোদন কিংবা পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। নৌকাতুল্য সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি ১২ হাজার মানুষ, দুই শতাধিক আবাসিক হোটেল, সরকারি ভবনসহ ৩ হাজার বসতবাড়ির চাপ সহ্য করতে পারছে না।
এর মধ্যে প্রতিবছর পর্যটন মৌসুমের অন্তত ছয় মাস ১০ হাজারের বেশি পর্যটক সেখানে রাত যাপন করেন। ফলে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এ দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে। দুর্গন্ধে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
এই অবস্থায় সেন্ট মার্টিন রক্ষায় কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের দাবি হচ্ছে, আগামী তিন বছর পর্যটন যাতায়াত বন্ধ করে মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন ও নীতিমালা প্রণয়ন। এটি সম্ভব না হলে নিবন্ধনের মাধ্যম প্রতিদিন ৬০০ জন পর্যটককে দ্বীপে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া। দ্বীপে পর্যটকদের রাতযাপন নিষিদ্ধ করা।
বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদ সভাপতি দীপক শর্মা বলেন, প্রতিদিন ১০ হাজার পর্যটক আর স্থানীয় ১২ হাজার মানুষের চাপে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পর্যুদস্ত। ২২ হাজার মানুষের মলমূত্র, ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হয়ে উঠেছে প্রবালদ্বীপ।
দুই শতাধিক হোটেল, বহুতল ভবনের জন্য পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। বৈদ্যুতিক পাম্প দিয়ে প্রতিনিয়ত সেন্ট মার্টিনের ভূগর্ভস্থ সুপেয় পানি উত্তোলন; শৈবাল, প্রবাল, কচ্ছপ, লাল কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুকসহ নানা জলজ প্রাণী নিধন; খোলা স্থানে পায়খানা স্থাপন ও পরিবেশ বিধ্বংসী কর্মকাণ্ডের কারণে এখন এই দ্বীপের আগের প্রকৃতির রূপ নেই। দুর্গন্ধে ভারী হয়ে উঠছে পরিবেশ।
দীপক শর্মা বলেন, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুবই পাতলা। এখানে অতিরিক্ত পর্যটক আগমনের কারণে পর্যটন মৌসুমে অতিমাত্রায় সুপেয় পানি উত্তোলন করা হয়। এতে দ্বীপের নলকূপে লবণাক্ত পানি আসছে। এতে সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দাদের জীবনযাপনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা। এখানে যদি কোনো রকম পরিবেশগত বা যেকোনো কারণে বিপর্যয় হয়, তা হলে এটি পুনরুদ্ধার করা কঠিন হবে। দ্বীপটিকে রক্ষা করতে প্রাকৃতিক যে অবয়ব ছিল, এগুলো যদি ব্যাহত হয়, তাহলে দ্বীপের বিপর্যয় হবেই।
দ্বীপের বিভিন্ন উদ্ভিদরাজিসহ বহু প্রাণী ইতিমধ্যে হারিয়ে গেছে। সামুদ্রিক কাছিমসহ বিভিন্ন প্রাণী সেন্ট মার্টিন ও ছেঁড়াদ্বীপে ডিম পাড়তে আসত। জরিপ করে দেখা গেছে, এর সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে গেছে।
অতিরিক্ত লোকসমাগম, রাতে বাতি জ্বালানো, ডিম পাড়াসহ বিচরণের পরিবেশ না থাকায় এসব কচ্ছপের দ্বীপে আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য এখনই যদি পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে বিপর্যয় ঠেকানো সম্ভব হবে না।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে সরকার। স্বচ্ছ পানি ও চারপাশজুড়ে প্রবাল-পাথরবেষ্টিত এই দ্বীপ বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থিত।
সেন্ট মার্টিন সামুদ্রিক কাছিমের প্রজননক্ষেত্রও। সেন্ট মার্টিনে ৬৮ প্রজাতির প্রবাল, ১৫১ প্রজাতির শৈবাল, ১৯১ প্রজাতির মোলাস্কা বা কড়ি-জাতীয় প্রাণী, ৪০ প্রজাতির কাঁকড়া, ২৩৪ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, ৫ প্রজাতির ডলফিন, ৪ প্রজাতির উভচর প্রাণী, ২৮ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী, ১২০ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ১৭৫ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২ প্রজাতির বাদুড়সহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বসবাস ছিল। এসব প্রাণী এখন বিলুপ্তির পথে। জলবায়ু পরিবর্তনের কঠিন সময়ে মানবসৃষ্ট দূষণের কারণে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে নানা প্রাণী।
স্মারকলিপি গ্রহণ করে জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, সরকারও চাইছে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশ সুরক্ষিত থাকুক। প্রাকৃতিক পরিবেশ সুরক্ষিত থাকলেই সেন্ট মার্টিনের গুরুত্ব বাড়বে পর্যটকদের কাছে। আর দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশ না থাকলে পর্যটকও আসবেন না।
স্মারকলিপি দেওয়ার সময়ে উপস্থিত ছিলেন বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জুনাইদ, কর্মকর্তা চন্দন কান্তি দাশ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রায়হান উদ্দিন চৌধুরী, পরিবেশকর্মী কামাল উদ্দিন, রাজীব দেবদাশ প্রমুখ।