স্কুল ধর্মঘটের দুই বছরের পরেও বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট অবিশ্বাস্যভাবে এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে
মূল: পরিবেশ কর্মী গ্রেটা থানবার্গ, লুইসা নেউবাউর, অনুনা ডি ওয়েভার এবং অ্যাডালেড চার্লিয়ার।
বাংলারূপ: সুলহাত সালেহীন
আমরা আমাদের পছন্দ মতো অনেক সভা করতে পারি, তবে এখন দেখার বিষয় হলো কতটুকু পরিবর্তন আনা যাবে। সমাজের সবার উচিত এই সমস্যাকে সংকট হিসেবে দেখা। জলবায়ু জড়তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট হচ্ছে।

২০ আগস্ট, বৃহস্পতিবার, প্রথম স্কুল ধর্মঘট সংঘটিত হওয়ার ঠিক দুই বছর পূরণ হয়েছে। পিছনে তাকালে ইতোমধ্যে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। জলবায়ু ও পরিবেশগত বিচারের জন্য কয়েক দশকের দীর্ঘ লড়াইয়ে যোগ দিতে লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমেছে এবং ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, ইউরোপীয় সংসদে একটি “ জলবায়ু ও পরিবেশগত” ঘোষণা প্রদান করেছে।
তবে এই গত দুই বছরে পৃথিবী থেকে ৮০ গিগাটন এরও বেশী কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়েছে। আমরা বিশ্বজুড়ে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখতে পেয়েছি: দাবানল, হিটওয়েভস লু হাওয়া, বন্যা, হারিকেন, ঝড়, পারমাফ্রস্টকে গলিয়ে ফেলা এবং হিমবাহ ও পুরো বাস্তুতন্ত্রের পতন।
হারিয়ে গেছে বহু জীবন ও জীবিকা। আর এই সমস্যা গুলো কেবল মাত্র শুরু। এভাবে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটতে থাকলে আরো অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হবে পুরো পৃথিবীর।
আজ, সারা বিশ্বের নেতারা এটিকে “অস্তিত্বের সংকট” হিসেবে আখ্যয়িত করছেন। জলবায়ুর জরুরী বিষয়ে অগণিত প্যানেল এবং শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনা করা হচ্ছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হচ্ছে, বড় বড় বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। তবুও, যখনই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আসে আমরা এখনও এড়িয়ে যাচ্ছি।
জলবায়ু এবং পরিবেশগত সঙ্কটকে একবারও সঙ্কট হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি। আমাদের যা করা দরকার এবং আসলে কী করা হচ্ছে তার মধ্যের ব্যবধানই মাত্র এক মিনিটের প্রশস্থতা কিন্তু ব্যবধানটি আরও প্রশস্ত হচ্ছে। মূলত, আমরা রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তার জন্য আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বছর হারিয়েছি।
গত মাসে, ইউরোপীয় কাউন্সিলের শীর্ষ সম্মেলনের ঠিক আগে আমরা ইইউ এবং বিশ্ব নেতাদের কাছে দাবিসহ একটি উন্মুক্ত চিঠি প্রকাশ করেছি। তখন থেকে ১২৫,০০০ এরও বেশি মানুষ এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন।
আমরা জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মের্কেলের সাথে দেখা করব। চিঠিটি এবং দাবিগুলি এবং পাশাপাশি স্বাক্ষরগুলি সরবরাহ করব (ইতোমধ্যে গত ২০ আগষ্ট ২০২০ তারিখে দেখা করা হয়েছে এবং দাবী সমেত চিঠির স্বাক্ষরসমূহ সরবরাহ করা হয়েছে)।

আমরা ম্যার্কেলকে বলব (বলা হয়েছে) যে তাকে অবশ্যই জলবায়ু জরুরী অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে – বিশেষত যেহেতু জার্মানি এখন ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছে। ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে এই ব্যাপারে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য ঐতিহাসিকভাবে বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের ২২% জন্য দায়ী, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পরেই এটির স্থান দ্বিতীয়। এই অনৈতিক কাজে যে দেশগুলি সমস্যা তৈরির জন্য দায়ী তারাই সবেচেয়ে বেশী খারাপ ফল ভোগ করছে। ইইউকে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে, যেভাবে এটি প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
আমাদের দাবী হলো সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানী বিনিয়োগ ও ভর্তুকি বন্ধ করা, জীবাশ্ম জ্বালানী সরিয়ে নেওয়া, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর ক্রিয়াকলাপ (ecocide) কে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা, শ্রমিকদের জন্য এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য সুরক্ষার নীতিমালা তৈরি করা, গণতন্ত্রকে সুরক্ষিত করা এবং সর্বোত্তম বিজ্ঞান ভিত্তিক বাধ্যতামূলক বার্ষিক কার্বন বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা ।
আমরা বুঝতে পারি পৃথিবীর জটিলতা এবং আমরা যা চাইছি তা সহজ নয় বা অবাস্তব বলে মনে হতে পারে। তবে এটি বিশ্বাস করা আরও অবাস্তব যে এই হুমকির মাঝে আমাদের সমাজগুলি, আমরা, যে বৈশ্বিক উষ্ণয়নের দিকে যাচ্ছি তা হতে বাঁচতে সক্ষম হতে হবে –
পাশাপাশি বর্তমানে অন্যান্য বিপর্যয়কর পরিবেশগত সুরক্ষা বজায় রাখতে কাজ করতে সক্ষম হতে হবে। আমরা অনিবার্যভাবে এক উপায়ে বা অন্যভাবে মৌলিকভাবে পরিবর্তন করতে চলেছি। কিন্তু প্রশ্নটি হল, পরিবর্তনগুলি কি
আমাদের শর্তে বা প্রকৃতির শর্তাবলীতে থাকবে?
প্যারিস চুক্তিতে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বৈশ্বিক গড় তাপমামাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এর নীচে রাখার এবং ১.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্যের প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। আমাদের দাবিগুলিতে এই প্রতিশ্রুতিটির অর্থ কী তা বোঝায়। তবুও তাদের এই প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে এই পদক্ষেপ গুলো নুন্যতম।
সুতরাং নেতারা যদি এটি করতে রাজি না হন তবে প্যারিস চুক্তিটি কেন ছেড়ে দিচ্ছেন তা তাদের ব্যাখ্যা করতে হবে। ব্যাখ্যা করতে হবে কেন তারা হতাশ হচ্ছে প্রতিশ্রুতি দেওয়ারর ব্যাপারে, সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চলে বসবাসরত মানুষের উপর হতাশ হওয়ার ব্যাপারে,তাদের বাচ্চাদের নিরাপদ ভবিষ্যতের হাতে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে, চেষ্টা না করে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে।
বিজ্ঞান কাউকে কী করতে হবে তা বলে না, এটি কেবল যাচাই করা তথ্য সংগ্রহ এবং উপস্থাপন করে। মূল বিষয়গুলো অধ্যয়ন এবং সংযোগ স্থাপন করা আমাদের উপর নির্ভর করে। আপনি যেমন জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারী প্যানেল –
আইপিসিসি (Intergovernmental Panel on Climate Change -IPCC) এর এসআর ১.৫ (SR1.5 report) প্রতিবেদন এবং জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচী – ইউএনইপি (United Nations Environment Programme -UNEP) এর কার্বন নির্গমনের ব্যবধানের প্রতিবেদনটি পড়েন, তেমনি প্যারিস চুক্তিতে নেতারা আসলে কি জন্য স্বাক্ষর করেছেন, আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে জলবায়ু এবং পরিবেশগত সঙ্কট আর আজকের ব্যবস্থাগুলির মধ্যে সমাধান করা যাবে না।
এমনকি আজকের শিশুরাও উপলব্ধি করতে পারে যে এই নীতিগুলি বর্তমানের সেরা বিজ্ঞানের সাথে যোগ হয় না।
আমাদের জীবন ব্যবস্থাকে সচল রাখতে আমাদের জীবনের চলমান ধ্বংসস্তূপকেই ধ্বংস করতে হবে আমাদেরকেই এবং একটি পুরোপুরি কার্বনমুক্ত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যেতে হবে যা সমস্ত লোককে, গণতন্ত্র এবং প্রাকৃতিক বিশ্বের কল্যাণ সাধনের জন্য।
যদি আমাদের উষ্ণায়নের ১.৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড এর নিচে থাকার সুযোগ থাকে তবে আমাদের নির্গমনগুলি তাৎক্ষণিকভাবে শূন্যের দিকে দ্রুত হ্রাস করা শুরু করতে হবে এবং তারপরে শূণ্যের চেয়ে কম নির্গমনে চলে যেতে হবে।
এটিই সত্য। যেহেতু আমাদের তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত সমাধান নেই, তাই আজ আমাদের হাতে যা আছে তা নিয়ে কাজ করতে হবে। এর জন্য আমাদেরকে অনেক কিছু বন্ধ করতে হবে। এটিও একটি সত্য।
তবে, এটি সত্য যে বেশিরভাগ মানুষ ইহা মেনে নিতে অস্বীকার করবে। এমন একটি ধারণা পোষণ করে আসাই একটি সঙ্কট যার থেকে বের হওয়ার জন্য আমরা কিছু ক্রয়, বা তৈয়ার বা বিনিয়োগ করতে পারি না বলে একরকম মানসিক যন্ত্রণা তৈরি হয়।
অজ্ঞতা, অস্বীকার এবং অসচেতনতার এই মিশ্রণটি সমস্যার কেন্দ্রস্থলে। এটি দুর করার জন্য আমরা সভা ও জলবায়ু সম্মেলন করতে পারি। তারা পর্যাপ্ত পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, কারণ কাজ করার সদিচ্ছার ও প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব রয়েছে। এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হল সমাজে সঙ্কটকে সংকট হিসাবে গণ্য করা।
আমাদের ভবিষ্যত এখনও আমাদের নিজের হাতে। কিন্তু সময় আমাদের আঙুলের ফাঁক দিয়ে দ্রুত পিছলে যাচ্ছে। আমরা এখনও সবচেয়ে খারাপ পরিণতি এড়াতে পারি। তবে এটি করার জন্য, আমাদেরকে জলবায়ু জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে এবং আমাদের নীতিগুলো পরিবর্তন করতে হবে এবং এই বাস্তবসত্যটা আমরা এড়াতে পারবো না।
[গ্রেটা থানবার্গ সুইডেনের এক ১৭ বছর বয়সী এক পরিবেশ প্রচারক। এই নিবন্ধটি রচনা করেছেন যৌথভাবে জলবায়ু কর্মীদের মধ্য থেকে জার্মানির লুইসা নেউবাউর, বেলজিয়ামের অনুনা ডি ওয়েভার এবং বেলজিয়ামের অ্যাডালেড চার্লিয়ার।]