27 C
ঢাকা, বাংলাদেশ
দুপুর ১২:২৫ | ১১ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ খ্রিস্টাব্দ | ২৭শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ বঙ্গাব্দ
গ্রীন পেইজ
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যতটা সফল, দুর্যোগের প্রস্তুতিতে আমরা ঠিক ততটাই পিছিয়ে
জলবায়ু

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যতটা সফল, দুর্যোগের প্রস্তুতিতে আমরা ঠিক ততটাই পিছিয়ে

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যতটা সফল, দুর্যোগের প্রস্তুতিতে আমরা ঠিক ততটাই পিছিয়ে

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ যুগ–যুগান্তরের। তারপরও ২০২২ সালে সিলেট জেলার বন্যা অনেকের জন্যই ছিল অভূতপূর্ব। বলা হচ্ছে, গত একশ বছরে সিলেটবাসী এমন বন্যা দেখেনি।

উজানে মেঘালয় রাজ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টির কারণেই এ অস্বাভাবিক ঢল এবং প্রলয়ংকরী বন্যা। বন্যা উপদ্রুত জনপদে মানুষের আহাজারি এবং আর্তনাদ আমরা দেখেছি, পত্রিকায় পড়েছি, শুনেছি এবং অনেকেই সাধ্যমতো সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

বন্যার্ত মানুষের দুর্দশা লাঘবে রাষ্ট্রীয়ভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যার ফলে দ্রুততম সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের ধরন এবং পরিমাণে সারা পৃথিবীতে যে পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তার আরেকটি উদাহরণই হচ্ছে গত বছরের এ অতিবৃষ্টিজনিত বন্যা।

সারা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানা দুর্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং দুর্যোগের চিরাচরিত রূপেও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে শীতপ্রধান ইউরোপীয় এবং আমেরিকান দেশগুলোতে উচ্চ তাপমাত্রা মানুষের দুর্ভোগের কারণ।



এমনকি শীতপ্রধান দেশে আমরা বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করতে দেখছি, যা অনেকের কাছে অস্বাভাবিক। হিমালয়ের বরফগলা পানিতে পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যা এবং নাইজেরিয়ায় অতিবৃষ্টিজনিত ভয়াবহ বন্যায় মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বৃষ্টি ও তাপমাত্রা পরিবর্তনে বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে মর্মে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

করোনা, ইবোলা মহামারিসহ অন্যান্য রোগের প্রাদুর্ভাবও জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনাবৃষ্টি ও দীর্ঘায়িত খরা খাদ্য উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এবং মরুর আবহাওয়াকে আরও চরমভাবাপন্ন করে তুলছে।

চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার আরেক উদাহরণ, চলতি বছরে আমেরিকা এবং কানাডায় অস্বাভাবিক তুষারপাত ও সাইক্লোন। পরিবেশের এ বৈরী আচরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবজাতির পরিবেশের প্রতি বৈরী আচরণকে। মানুষের হাজার বছরের ইতিহাস যেন প্রকৃতির ওপর আধিপত্যের গাথা।

বন কেটে বানিয়েছে নগর, মাটির তলদেশ থেকে আহরণ করেছে খনিজ—আরও কত–কী! নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে বানিয়েছে বাঁধ—এ যেন প্রকৃতির ওপর বিজয় লাভ করার এক বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা, কার চেয়ে কে বেশি করতে পারে। এবার প্রকৃতির জবাব দেওয়ার পালা, প্রতিশোধের কঠিন পর্ব।

বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, সিলেট বিভাগের বিগত বন্যায় প্রায় ৪৩ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যাঁদের মধ্যে প্রায় ৯ লাখ নারী ও পুরুষ সাময়িকভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। পত্রপত্রিকা এবং বিভিন্ন প্রতিবেদনে সাধারণ যে ভোগান্তি এবং কষ্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার সমস্যাগুলো তেমন গুরুত্ব পায়নি।

পত্রিকায় আমরা দেখেছি, সুনামগঞ্জ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক সন্তানসম্ভবা মাকে জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য ৫০ হাজার টাকা নৌকাভাড়া দিতে রাজি হয়েছিল ভুক্তভোগীর পরিবার, যদিও প্রকৃত ভাড়া ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। বন্যাকবলিত বেশির ভাগ স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান কেন্দ্রে সেবাদান কর্মীরা যেতে না পারায় কেন্দ্রগুলো বন্ধ ছিল।



সরকারিভাবে মেডিকেল টিম গঠন করে জরুরি সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা হলেও এর আওতায় গর্ভবতী মা, প্রসূতি ও নবজাতকের স্বাস্থ্যসেবাকে কতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তা আমরা নিশ্চিত নই।

বন্যা, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকায় সেবাকেন্দ্রগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়।

এ কারণে দুর্যোগ আক্রান্ত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী এবং কিশোরীরা প্রয়োজনীয় গর্ভকালীন সেবাসহ অন্যান্য সেবা থেকে বঞ্চিত হন। নারী ও কিশোরীদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা এখনো গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত দুর্ভোগকে সাধারণত তিন ভাগে দেখা হয়—আর্থসামাজিক বিচ্ছিন্নতা, শিক্ষাব্যবস্থার বিপর্যয় এবং আয়ের উৎস বাধাগ্রস্ত হওয়া। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় বন্যার্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আর্থিক সংকটের কারণে সস্তা খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য হয় এবং অপুষ্টিতে ভোগে।

আর্থিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করা, পরিবারে কিশোরীদের বিয়ে দেওয়া, নারীর প্রতি সহিংসতার কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি, কিন্তু কিছু বিষয় আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়। দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষ যখন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেয়, সেই সময় পুরুষদের চেয়ে নারীদের ভোগান্তিই অনেক বেশি হয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে নারী-পুরুষের ভিন্ন টয়লেটের ব্যবস্থা থাকে না। নারী এবং কিশোরীদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত। গর্ভবতী মায়েদের কষ্ট আরও বেশি। জরুরি গর্ভকালীন ও প্রসবসেবার কোনো ব্যবস্থা না থাকায় অনেক গর্ভবতী মা ও নবজাতকের জীবন বিপন্ন থাকে। দুর্যোগের সময় পরিবার পরিকল্পনা সেবার প্রয়োজনীয়তার কথা বিবেচনাই করা হয় না।



পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগ সাতক্ষীরা ও গাইবান্ধা জেলায় দুর্যোগপরবর্তী সময়ে মায়েদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা এবং সার্বিক পরিস্থিতি জানতে একটি গবেষণা পরিচালনা করে।

গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্যোগের সময় সাতক্ষীরা এবং গাইবান্ধা জেলায় যথাক্রমে ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ৭৩ দশমিক ৪ শতাংশ কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, দুর্যোগের সময় এবং পরবর্তী সময় জেলা দুটিতে ৮৯ শতাংশ (সাতক্ষীরা) এবং ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ (গাইবান্ধা) নারী নানা রকম সহিংসতার শিকার হন।

জেলা দুটিতে যথাক্রমে ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশ এবং ২৫ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ সদস্য জীবিকার তাগিদে অন্যত্র চলে যান এবং তাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময় ফেলে আসা পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ রাখেন না। গর্ভবতী মায়েদের সেবার ক্ষেত্রেও খুবই হতাশাজনক চিত্র।

জেলা দুটিতে ২০ শতাংশের কম গর্ভবতী নারী দুর্যোগকালে চার বা তার বেশিবার প্রসবপূর্ববর্তী সেবা নিচ্ছেন, যা জাতীয় পর্যায়ের গড় (৪৭ শতাংশ) হারের তুলনায় অনেক কম।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আমরা যতটা সফল, দুর্যোগের প্রস্তুতিতে আমরা ঠিক ততটাই পিছিয়ে। জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সুবিন্যস্ত সেবাকেন্দ্র এবং সুপ্রশিক্ষিত সেবাকর্মীদের মাধমে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদান কার্যক্রম বিদ্যমান, যার মাধ্যমে আমাদের অর্জন অনেক।

কিন্তু বন্যা, সাইক্লোনসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকায় সেবাকেন্দ্রগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবাদান কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়। এ কারণে দুর্যোগ আক্রান্ত জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে নারী এবং কিশোরীরা প্রয়োজনীয় গর্ভকালীন সেবাসহ অন্যান্য সেবা থেকে বঞ্চিত হন।



নারী ও কিশোরীদের দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা এখনো গুরুত্ব দিয়ে ভাবছি না। দুর্যোগের সময় নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিকল্পনা গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা উচিত।

সঠিক এবং সময়োপযোগী প্রস্তুতি নিতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় গর্ভবতী মায়ের আহাজারি, কষ্টের খবর, গত বছরগুলোর মতোই পত্রিকার কাটতি বাড়াবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

“Green Page” কে সহযোগিতার আহ্বান

সম্পর্কিত পোস্ট

Green Page | Only One Environment News Portal in Bangladesh
Bangladeshi News, International News, Environmental News, Bangla News, Latest News, Special News, Sports News, All Bangladesh Local News and Every Situation of the world are available in this Bangla News Website.

এই ওয়েবসাইটটি আপনার অভিজ্ঞতা উন্নত করতে কুকি ব্যবহার করে। আমরা ধরে নিচ্ছি যে আপনি এটির সাথে ঠিক আছেন, তবে আপনি ইচ্ছা করলেই স্কিপ করতে পারেন। গ্রহন বিস্তারিত