দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করা সত্ত্বেও বেড়ে গেছে প্লাস্টিকের ব্যবহার
আধুনিক যুগ প্লাস্টিকের যুগ। বিভিন্ন রকম প্লাস্টিকের প্যাকেট, ব্যাগ, বোতল, বালতি, ক্যান, কাপ, মগ, গ্লাস, স্ট্র ইত্যাদি নানান ধরণের নিত্য ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। শুধু তাই নয়।
পানির ট্যাঙ্ক, দরজা, চেয়ার, টেবিলসহ ঘর সাজাতে প্লাস্টিকের রমরমা সমাহার। সুবিধাও অনেক। দামে সস্তা, ওজনে হাল্কা, মজবুত এবং পানিতে নষ্ট হয় না। রং মিশিয়ে যেমন খুশি তেমন আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়। প্লাস্টিক পণ্য তাই এ যুগে অনন্য। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্লাস্টিক রূপান্তরিত হয়েছে নানান ডিজিটাল গ্যাজেট পণ্য।
একথা কে না জানে যে, প্লাস্টিকের পঁচাত্তর শতাংশেরও বেশি বর্জ্য হিসেবে পরিত্যক্ত হয়। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক জলবায়ু, আকাশ-বাতাস, নদ-নদী, সাগর-মহাসাগরসহ গোটা বিশ্ব প্রকৃতিকে দূষিত করে তুলছে। বিলিয়ন বিলিয়ন টন প্লাস্টিক সাগরে পড়ছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মুখে, প্রসঙ্গ তাই একটাই ‘প্লাস্টিক দূষণ’। জঘন্য এই দূষণে ডুবে যাচ্ছে বিশ্বের মানব সভ্যতা। প্লাস্টিক দূষণ নিয়ে তাই বড়ই চিন্তিত মানুষ। কারণ, এই দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করা সত্ত্বেও বেড়ে গেছে প্লাস্টিকের ব্যবহার।
প্লাস্টিক কি?
প্লাস্টিক মানে বিষ। প্লাস্টিক উৎপন্ন হয় কার্বনের পলিমার যৌগ দিয়ে। কার্বনের পলিমার যৌগগুলো পলিথিন, পলিস্টাইরিন, পলিপ্রপিলিন ইত্যাদি নামে পরিচিত। কে না জানে, সাধারণ যেকোনো জিনিস খোলা পরিবেশে রেখে দিলে কিছুদিনের মধ্যে এর পচন ধরে। পচনের এই কাজটা করে অণুজীব।
বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রকৃতিতে থাকা সব ধরণের পদার্থকেই ভেঙে সরল উপাদানে পরিণত করতে পারে এই অণুজীব। কিন্তু প্লাস্টিকের মতো পদার্থকে ভাঙা অণুজীবের বাপেরও সাধ্যি নেই। তাই একে ‘অপচ্য পদার্থ’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়। প্লাস্টিক এমন এক অপচনশীল রাসায়নিক পদার্থ যা কারখানায় পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ বা নবায়ন করা গেলেও প্রচুর সময় ও খরচ লেগে যায়।
বিষাক্ত কার্বনের এই পলিমার যৌগ কখনো জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিবেশের অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মিশতে পারে না। তাই প্রকৃতিতে জমা হওয়া এই প্লাস্টিক বছরের পর বছর অবিকৃত থেকে পরিবেশকে বহুভাবে দূষিত করে। যেমন, মাটির নীচে প্লাস্টিকের কারণে বৃষ্টির পানি মাটির ভেতরে ঢুকতে বাঁধা পায়।
ফলে ভূগর্ভস্থ পানির ভান্ডার পূর্ণ হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। মাটির ফসল উৎপাদন ক্ষমতার ব্যাঘাত ঘটে। গাছপালা, ফল-ফসলের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। এক কথায়, মাটির পানি ধারণ ক্ষমতা, বায়ু চলাচল ক্ষমতা, সংশক্তি-আসক্তি, আয়ন বিনিময় ক্ষমতা ইত্যাদি পরিবর্তন ঘটিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য নস্ট করছে এই প্লাস্টিক।
খাবারে ঢুকছে প্লাস্টিক কণা
শহর অঞ্চলের নিকটবর্তী নিম্নাঞ্চল ভূমিতে প্রায় দেখা মেলে ছোট বড় পলিথিন টুকরো আর প্লাস্টিকের কণার পাহাড়। অনেকদিন এভাবে পড়ে থেকে পরিবেশগত তাপ, চাপসহ অন্যান্য কারণে বড় আকারের প্লাস্টিক ক্রমান্বয়ে পরিণত হচ্ছে ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায়। এসব অতি ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার নাম মাইক্রোপ্লাস্টিক।
পাঁচ মিলিমিটার কিংবা তারও ছোট আয়তনের এসব ছোট প্লাস্টিক কণা খালি চোখে দেখা যায় না। কণাগুলো আবহাওয়া প্রভাবিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে ছোট ছোট টুকরো হয়ে বাতাসে বা পানিতে মিশে। সম্প্রতি প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়ায় মানুষের শরীরে প্লাস্টিকের কণার প্রভাব নিরূপণে গবেষণায় সংগৃহিত মাছের নমুনায় ৮৫ শতাংশ তেলাপিয়া মাছে প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
এভাবে প্লাস্টিক কণা খাবারেও ঢুকে পড়ছে। মানুষের পানযোগ্য পানিতেও প্লাস্টিক কণা পাওয়া যাচ্ছে। স্থানীয় জলবায়ুতে এই প্লাস্টিক কণা দূষিত করায়, যুক্তরাজ্য সরকার ইতোমধ্যে ১৫ বিলিয়ন প্লাস্টিক ব্যাগ বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
প্লাস্টিক বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ
বাংলাদেশে বেশি লাভের আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা পলিব্যাগ তৈরি করতে নিম্নমানের রাসায়নিক দ্রব্য ও ক্ষতিকর রং যেমন: ক্যাডমিয়াম, লেড, টাইটেনিয়াম, থ্যালেট, ক্রোমিয়াম, নিকেল, কপার ইত্যাদি ব্যবহার করে। বাংলাদেশে কসমেটিকসসহ গৃহস্থালি এবং বাণিজ্যিক কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেশি হয়।
শহরাঞ্চলগুলোতে বছরে সাড়ে ৮ লাখ টন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পলিথিন উৎপন্ন হয়। মানুষের অসচেতনতার কারণে এসব পরিত্যক্ত পলিথিনের শেষ ঠাঁই হয় পুকুর, নর্দমা, খাল-বিল, নদী-নালা প্রভৃতি স্থানে। বছরে ২ লাখ ৮ হাজার টন প্লাস্টিক নদ-নদীর পাড়ে ও উপকুলীয় এলাকার আশপাশে পুঁতে ফেলা হয়।
ফলে অপচনশীল প্লাস্টিক মাটিতে থেকে যায় বছরের পর বছর। গবেষণা মতে, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরাঞ্চলের ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ প্লাস্টিক অব্যবস্থাপনা। বর্ষায় প্রবল বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত পলিব্যাগ, প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল শহরের পানি নিষ্কাষণ পাইপ, ড্রেন ইত্যাদির মধ্যে নিরবিচ্ছিন্ন পানি সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।
আর হ্যাঁ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে বর্ষায় প্রবাহিত পানিতে থাকা প্রচুর পরিমাণে ভাসমান প্লাস্টিক, পলিব্যাগ, জুসের বোতল নদ-নদীর দু’পাড়ে আটকা পড়ে স্থানীয় পরিবেশ দূষণ ঘটাচ্ছে। নদীগুলোতে জেলেদের জালে উঠে আসছে টন টন প্লাস্টিক। যা পরবর্তীতে পরিবেশ তথা প্রাণিজগতের জন্য ডেকে আনে মহাবিপর্যয়।
যেমন, প্লাঙ্কটন সাইজের এই প্লাস্টিক কণাকে জলজ প্রাণী প্রায়ই খাদ্য মনে করে ভুল করে গিলে খায়। জলজ প্রাণী এসব খাবার হজম করতে না পেরে মারা যায়। সেসব মৃত, রোগাক্রান্ত জীবিত মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে খাদ্য চক্রের আবর্তে আবার মানুষের পেটে চলে যায়।
এভাবে নদী ও সাগরে ফেলে দেয়া টুকরো টুকরো প্লাস্টিক কণা মাছের খাবারের মাধ্যমে মানব দেহে প্রবেশের আশঙ্কা দিন দিন প্রবলতর হচ্ছে। ইতালিতে সাগরের পানিতে ভাসমান রাশি রাশি পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতল, ক্যান ও পলিব্যাগ, খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে শত শত ডলফিন ও কচ্ছপ মারা গেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিল্লীতে গরু মারা গেছে পলিথিন খেয়ে। মৃত গরুর পেট থেকে পাওয়া গেছে প্রায় ৬৭ কেজি পলিব্যাগ। তাই ‘অ্যালেন ম্যাক আর্থার ফাউন্ডেশন’ ঠিকই আশংকা করেছে: ‘২০৫০ সালের মধ্যে সাগরে মাছের চেয়ে প্লাস্টিকের পরিমাণ বেশি হবে।’ পরিসংখ্যান মতে, প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে মৎস্য ও পর্যটন খাতে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার তিন শ’ কোটি ডলার।
প্লাস্টিক দূষণ রোধে রোল মডেল বাংলাদেশ
বড়ই গর্বের বিষয়, বিশ্বে বাংলাদেশই প্রথম দেশ। যে দেশটা পরিবেশ দূষণ রোধে সবার আগে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করে রোল মডেল হিসেবে বিশ্বে অনুকরণীয়। প্লাস্টিক দূষণ থেকে পরিত্রাণে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (২০০২ সালের সংশোধিত) ৬ এর (ক) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতা বলে যে কোন প্রকার প্লাস্টিক, পলিথিন, শপিং ব্যাগ, বা পলিইথাইলিন বা পলিপ্রপাইলিনের তৈরি (অন্যকোন সামগ্রী পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলে এরূপ) সামগ্রীর উৎপাদন, আমদানি বাজারজাত বা বিক্রয়ের জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।
দেখাদেখি পৃথিবীর অন্য অনেক দেশ অতি সম্প্রতি প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। উদাহরণত: মরক্কো ২০১৬ সালে ও কেনিয়া ২০১৭ সালে প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ভারতে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ, প্লাস্টিকের বাসনপত্র, থার্মোকলের ডিশ-কাঁটা-চামচ, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি অফিসে প্লাস্টিকের ফুল, ফোল্ডার, পানির বোতল, ব্যানার, প্লাস্টিকের টব ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ জারি করা হয়েছে এ বছর ২ অক্টোবর ২০১৯।
মাত্র ক’দিন আগে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন সিদ্ধান্ত নেয় যে, ২০২১ সালের মধ্যে প্লাস্টিকের স্ট্র, চামচ, ছুরি, কটন বাড এসব নিষিদ্ধ করা হবে। অতি সম্প্রতি জাতিসংঘ আহ্বান জানায়, পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে সব দেশেই প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। প্লাস্টিক দূষণ মুক্ত করতে এখন অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা গড়ে উঠেছে। তারা তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে বিশ্বকে প্লাস্টিকমুক্ত করতে প্রচেষ্টা শুরু করেছে।