দখলমুক্ত করা হলো সাভারের বংশী নদী
স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাভারের বংশী নদীর তীরে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে বহু স্থাপনা। এক সময় এই অবৈধ দখলের ফলে নদী তার স্বাভাবিক গতিপথ হারিয়ে ফেলে, দূষিত হয় নদীর পানি এবং এর আশেপাশের পরিবেশ। সম্প্রতি সাভার উপজেলা প্রশাসন বংশী নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করেছে। এতে স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন নদীপাড়ের মানুষ।
সাভার উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ১৩৩৪০২০১৯ নং রিট মামলার আলোকে বংশী নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত রাখার জন্য ৬০ (ষাট) দিনের মধ্যে উচ্ছেদ কার্যক্রম সম্পন্ন করার নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পরে জেলা প্রশাসক ও বিজ্ঞ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০২২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর বংশী নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য পাঁচ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
পরে ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর দুই দিন নদী তীরবর্তী প্রায় দুই একর নদীর ও এক একর খাস জায়গা উদ্ধার করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর এ উচ্ছেদ অভিযানে অংশ নেয় বিআইডব্লিউটিএ। পরে ৩০ ও ৩১ সেপ্টেম্বর প্রায় দুই একর নদীর জায়গা এবং তিন একর খাস জায়গা উদ্ধার করা হয়।
মোট চার দিন আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বংশী নদীর তীরবর্তী উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং ২৮৬ জন অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়। অভিযানে প্রায় চার একর নদীর জায়গা এবং প্রায় চার একর খাস জমি উদ্ধার করা হয়।
আরও জানা যায়, এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সাভার উপজেলা প্রশাসন, সাভার পৌরসভা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, পল্লি বিদ্যুৎ, ফায়ার সার্ভিসসহ অন্যান্য সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় সাভার উপজেলার বংশী নদীর তীরবর্তী অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান হয়।
এ উচ্ছেদ অভিযানে সাভার উপজেলার নাগরিক কমিটি পরিবেশবাসী কমিটি, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে সকল স্তরের জনগণ সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন। উচ্ছেদ পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসন, ঢাকা, বিআইডব্লিউটিএ ও উপজেলা প্রশাসন, সাভারের যৌথ উদ্যোগে বংশী নদীর সীমানা চিহ্নিত করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সম্পূর্ণভাবে আলাদা করা হয়। যেন নদীর জায়গা পুনরায় অবৈধভাবে দখল না হয়।
শুক্রবার সরেজমিনে বংশী নদীর সাভার নামাবাজার ও নয়ারহাটসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, নদীটি এখন পুরোপুরি দখলমুক্ত রয়েছে। কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে নদীর পাড়।
সাভার নামাবাজারের স্থানীয় বাসিন্দা দীন ইসলাম বলেন, বংশী নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার কারণে নদীর কিনারায় দাঁড়ানো যেত না কিন্তু এখন অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেওয়ায় নদীর কিনারা ঘুরে দেখা যাচ্ছে।
আরেক বাসিন্দা মিলন সরকার বলেন, বংশী নদী অবৈধ দখলমুক্ত রয়েছে। নদীর যে অংশটুকু উদ্ধার করা হয়েছে তা অতিদ্রুত খনন করা প্রয়োজন। সরকারের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের এ বিষয়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বংশী নদী পুনরায় দখল হবে না এমন প্রত্যাশা আমাদের সবার।
সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করেছি। অবৈধ স্থাপনাগুলো অপসারণ করা হয়েছে।
ভূমি জরিপের মাধ্যমে সেখানে হাট-বাজার ও নদীর জমি পৃথক করে সেখানে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কাঁটা তারের মাধ্যমে সীমানা করে দেওয়া হয়েছে৷
তিনি আরো বলেন, আমরা যে দখল মুক্ত করেছি এটি টেকসই করতে হলে নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে (হাঁটার ব্যবস্থা), নদী পূর্ণ খননসহ আরও কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সেক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন পানি উন্নয়ন বোর্ড ও সাভার পৌরসভারও উন্নয়ন করার সুযোগ রয়েছে৷ এছাড়া দখলমুক্ত করার পরবর্তী সময় আবারও অবৈধ স্থাপনা যেন না বসে সেদিকে উপজেলা প্রশাসন সব সময় নজর রাখবে৷
তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন থেকে অভিযানের পরেও এখানে অবৈধ দখলদাররা আবারও স্থাপনা তৈরির চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আমাদের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সেই অবৈধ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করেছেন।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, নদী একটি চলমান সড়কের মতো। নদী একটি প্রবাহ মান পানির ধারা।
নদী যদি আমরা ভরাট করি বা দখল করি তাহলে নদীর এরিয়া বা স্থান সংকুচিত হয়ে যায়। এতে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয় এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে।
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, বর্তমানে উপজেলা প্রশাসন এই নদী দখল মুক্ত করতে অনেক কাজ করেছে৷ আমি বিগত দেড় বছর ধরে দেখছি, তারা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু আবারও অবৈধ দখলদাররা চেষ্টা করছেন দখল করতে। এগুলো বন্ধ করতে আমাদের সবার এক হয়ে কাজ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, মানুষের ভেতর দখলদারিত্বের ও নদীকে দূষণ করার ঘৃণ্য প্রবৃত্তি তৈরি হয়েছে। আবার কেউ নদী দখলের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।