নদী রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ অপরিহার্য
পৃথিবীর অধিকাংশ শহর-বন্দর গড়ে উঠেছে সমুদ্রকে ঘিরে। একইভাবে মানবসভ্যতা, সংস্কৃতির বিকাশও নদ-নদীকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। আর আমাদের দেশ নদীমাতৃক দেশ। জালের মতো নদী জড়িয়ে রেখেছে বাংলাদেশে। কিন্তু ‘দাঁত থাকতে মানুষ যেমনি দাঁতের মর্যাদা বুঝে না, তেমনি নদী থাকতে নদীর মর্যাদা দিচ্ছি না আমরা।’
জীবনপ্রবাহকে সচল রাখা নদীগুলোকে প্রতিনিয়ত আমরা হত্যার মহোৎসবে লিপ্ত রয়েছি। এটি অর্থনীতির জন্য, জীবনপ্রবাহের জন্য দুঃসংবাদ।
তাই আমাদের প্রাণরসায়ন সচল রাখতে নদী রক্ষার কার্যকর উদ্যোগ অপরিহার্য। নদী আমাদের আত্মা, আমাদের দেহে রক্ত সঞ্চালক, হৃদয়ের স্পন্দন। এসব গুরুত্ব বিবেচনায় নদীকে নদীর মতো থাকতে না দিলে অর্থনীতি, সভ্যতা, সংস্কৃতি- সবই পড়বে হুমকিতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৪০৫ উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর বিভাগে ৮০ নদীর তথ্য উঠে এসেছে।
আর জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের খসড়া তথ্যে, দেশের ৯০৭টি নদীর মধ্যে রংপুর বিভাগে নদীর সংখ্যা ১২১টির উল্লেখ আছে। এই ১২১ নদীর বাইরে আরো শতাধিক নদী আছে ওই অঞ্চলে। রিভারাইন পিপলের পক্ষে সেই শতাধিক নদীর নাম কমিশনের কাছে দিয়েছে।
এর মধ্যে ৬৩টি সচিত্র, ১৬টি সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ আরো ২৬টির নাম দেওয়া আছে। ইতিমধ্যে কমিশন-সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের কাছে অনেকগুলো নদীর তথ্য চেয়ে চিঠিও দিয়েছে।
চিঠিতে তারা আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, ‘নদী না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না, প্রকৃতি বাঁচবে না, পরিবেশের সুরক্ষা হবে না, এমনকি টেকসই উন্নয়নও সম্ভব নয়।’
বর্তমানে সারা দেশেই আগ্রাসী থাবায় নদীগুলো বিপর্যস্ত। যেকোনো নদীর পাড়ে তাকালেই দখল-দূষণের চিত্র দৃশ্যমান হয়। এ অবস্থায় বহু নদ-নদীর অস্তিত্বই এখন হুমকির মুখে।
বাস্তবে অনেক নদী ইতিমধ্যেই হারিয়ে গেছে। শুধু দখল ও দূষণের কারণে গত ৪ দশকে দেশের ৪০৫টি নদ-নদীর মধ্যে বিলুপ্তর পথে ১৭৫টি। বাকি ২৩০টিও রয়েছে ঝুঁকির মুখে।
২৪ হাজার কিলোমিটার নৌপথ কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার কিলোমিটারে। কৃষি, যোগাযোগ, পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, মানুষের জীবনযাত্রা সবকিছুর জন্যই এটা ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। নদী-জলাশয় রক্ষার প্রয়োজনীয়তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, ঢাকা-চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানিতে ১১ ধরনের ক্ষতিকর ধাতুর দেখা মিলেছে। গবেষণায় যেসব নদী, হ্রদ বা খালের দূষণের তথ্যবিশ্লেষণ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে- ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী, বংশী, ধলাই বিল, মেঘনা, সুরমা, কর্ণফুলী, হালদা, খিরু, করতোয়া, তিস্তা, রূপসা, পশুর, সাঙ্গু, কাপ্তাই লেক, মাতামুহুরী, নাফ, বাকখালী, কাসালং, চিংড়ি, ভৈরব, ময়ূর ও রাজখালী খাল।
আর এসব জলাধারের পানিতে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে জিংক, কপার, আয়রন, লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, ম্যাঙ্গানিজ, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কার্বন-মনোক্সাইড ও মার্কারির উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ৪০ বছরে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ আশপাশের অবিচ্ছিন্ন নদীগুলো চরম মাত্রার দূষণের শিকার হয়েছে। বরিশালের কীর্তনখোলা, বরগুনার খাকদোন নদীও মরে যাচ্ছে। নদীগুলো যে দখলই হচ্ছে তা নয়, শিল্পবর্জ্যরে ভারী ধাতু পানিতে মিশে নদীর তলদেশে মারাত্মক দূষণ তৈরি করে।
বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে নদীর পানিতে ক্ষতিকর ধাতুর ঘনত্ব বেশি পাওয়া যায়। দেশে নদ-নদীর প্রকৃত সংখ্যা নিরূপণে ২০১৯ সালে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি)। প্রায় চার বছর কাজ শেষে গত ১০ আগস্ট সংস্থাটির ওয়েবসাইটে ৯০৭টি নদ-নদীর খসড়া তালিকা প্রকাশিত হয়।
এ সংখ্যা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন নদী গবেষকরা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত নদ-নদীর তথ্যের সঙ্গেও এনআরসিসির খসড়ার তথ্য মিলছে না।
গবেষকদের মতে, দেশের টেকসই উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামাজিক ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় নদ-নদী রক্ষা করা জরুরি। গবেষণা অনুযায়ী, গত ৫০ বছরে মানুষের কারণে ২০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি, ৩০ শতাংশ বনভূমি এবং ১০ শতাংশ চারণভূমি হারিয়ে গেছে।
শুধু আবাসন ও শিল্পায়নের কারণে প্রতি বছর ১ শতাংশ কৃষিজমি কমছে। একই সঙ্গে জীববৈত্র্যিও বিলুপ্ত হচ্ছে। ইতিমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি নদী বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বাকিগুলো দূষণে ও দখলে বিপর্যস্ত।
টেকসই উন্নয়নের জন্য যে অর্থনীতি প্রয়োজন, সেই অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে হলে নদীকে তার হারানো গৌরব ও যৌবন ফিরিয়ে দিতে হবে, সচল রাখা জরুরি এর গতিপ্রবাহ।
কারণ নদীর সঙ্গে আমাদের প্রকৃতি, অর্থনীতি, পর্যটন, যাতায়াত, পরিবেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। টেকসই উন্নয়ন ও নদী রক্ষায় সম্মিলিতভাবে সামনে এগোতে হবে। নদীর ব্যবহার এখন বহুমাত্রিক।
মানুষ বুঝে না বুঝে নদীকে ব্যবহার করছে। নদীর কাছেই গড়ে উঠেছে বড় বড় কল-কারখানা, নদীতে চলে এখন হাজার হাজার লঞ্চণ্ডস্টিমার। নদীতে শত শত বাঁধ। নদী দখল, নদীদূষণসহ যখন যেভাবে প্রয়োজন, তখন সেভাবেই নদীকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের গঠন করা বিভাগীয় নদী, খাল, বিল, জলাশয়বিষয়ক কমিটি কার্যকর থাকলে নদী চিহ্নিত করা সহজ হবে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উচিত হবে নদীর সংখ্যা চূড়ান্ত না করা।
কারণ যখন যে নদীর নামণ্ডতথ্য পাওয়া যাবে, তখনই সেগুলো যুক্ত করার কাজ চলমান রাখা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সেই লজ্জা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নদীর তালিকা শতভাগ বস্তুনিষ্ঠ হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
পরিবেশ প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি সচল রাখতে হলে, টেকসই উন্নয়নে নদ-নদীকে সংরক্ষণ করা অপরিহার্য। এসব করা না গেলে ভবিষ্যতে আরো সংকটে পড়তে হবে। নিশ্চয়ই সেই সর্বনাশা সময়ের প্রত্যাশা করে না কেউ।