শিশুদের শরীরে উচ্চমাত্রার সিসা: প্রসাধনী থেকেও ছড়াচ্ছে দূষণ
বাংলাদেশে মানবদেহে সিসার উপস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা চললেও উদ্বেগ কমার কোনো লক্ষণ নেই; বরং নতুন তথ্য পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার শিশুদের রক্তে সিসার মাত্রা নিরাপদ সীমার প্রায় দ্বিগুণ। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ পরিচালিত এই গবেষণায় দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী পাঁচশ শিশু অংশ নেয়, যার মধ্যে প্রায় আটানব্বই শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার পরিমাণ ভয়ঙ্করভাবে বেশি।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সাড়ে তিন কোটিরও বেশি শিশুর রক্তে বিপজ্জনক মাত্রায় সিসা রয়েছে, যা বিশ্বের মধ্যে অন্যতম উচ্চহার।
এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে যে সীমিত মাত্রার সিসা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সহনীয় ধরা হয়, শিশুদের জন্য তাও নিরাপদ নয়। সিসা একবার রক্তে প্রবেশ করলে সহজে বের হয় না; তা হাড়, মস্তিষ্ক এবং অন্যান্য অঙ্গে জমে থেকে শিশুদের বিকাশ, স্নায়ুতন্ত্র এবং শিক্ষাগত সক্ষমতায় স্থায়ী ক্ষতি করে।
দূষণের উৎস বহুমুখী। প্রচলিতভাবে ব্যাটারি কারখানা, শিল্পবর্জ্য, পুরনো রঙ এবং দূষিত পানির কথা বেশি বলা হলেও সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে অনিয়ন্ত্রিত প্রসাধনী ও সৌন্দর্যপণ্যকেও বড় একটি কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
সস্তা ও মানহীন এসব পণ্যে সিসার উপস্থিতি থাকলে তা খুব সহজেই দৈনন্দিন জীবনের মাধ্যমে শিশুদের শরীরে প্রবেশ করতে পারে। শহর ও গ্রামে অনেক শিশু অনিচ্ছাকৃতভাবে মায়ের লিপস্টিক, সিন্দুর বা ফেসপাউডারের সংস্পর্শে আসে, যা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তোলে।
এটি কেবল স্বাস্থ্যগত সংকট নয়, বরং দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রভাবও ফেলতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সিসা-দূষণ প্রতি বছর বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রায় নয় শত ছিয়াত্তর বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতির কারণ হয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি ভবিষ্যতে উৎপাদনশীলতা হ্রাস, শিক্ষাগত সাফল্যে পিছিয়ে পড়া এবং স্বাস্থ্যব্যয় বৃদ্ধি করে উন্নয়নযাত্রাকে ধীর করে দিতে পারে।
এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক ও সমন্বিত পদক্ষেপের প্রয়োজন। সিসা-দূষণের উৎস চিহ্নিত করে কঠোর নিয়ন্ত্রণ, মানসম্মত শিল্পবর্জ্য ব্যবস্থাপনা, প্রসাধনীর উপাদান নিয়ন্ত্রণ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এই সঙ্কট থামানো সম্ভব হবে না। প্রতিটি বিলম্ব নতুন প্রজন্মের ওপর স্থায়ী প্রভাব ফেলছে, যা সময়ের সঙ্গে মুছে ফেলা ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠবে।