সাভার বাংলাদেশের প্রথম ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা: বায়ুদূষণের সতর্কবার্তা
গ্রিনপেজ রিপোর্টার
অসাধারণ এক পদক্ষেপে পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) গত রোববার ঢাকার পার্শ্ববর্তী সাভার উপজেলার পুরো এলাকা ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এটি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন ঘোষণা। এলাকাটির বায়ুর মান নাজুক অবস্থায় পৌঁছেছে, যা ঢাকার মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
ডিগ্রেডেড এয়ারশেড কী?
বায়ুদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০২২ অনুযায়ী, কোনো এলাকার বায়ুদূষণ জাতীয় নিরাপদ মান অতিক্রম করলে সেই অঞ্চলকে ‘ডিগ্রেডেড এয়ারশেড’ ঘোষণা করা যেতে পারে। বিধি অনুযায়ী, এই ঘোষণা কার্যকর হলে সেখানে বিশেষ পরিবেশ আইন প্রযোজ্য হয়, শিল্প ও প্রকল্পগুলোকে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করতে বাধ্য করা হয় এবং দূষণ সৃষ্টিকারী কিছু কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ করতে হতে পারে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সাভারের বায়ুর বার্ষিক মান জাতীয় সীমার প্রায় তিন গুণ অতিক্রম করেছে। শুষ্ক মৌসুমে উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিক থেকে প্রবাহিত বাতাস দূষিত কণাকে ঢাকার দিকে নিয়ে আসে, ফলে রাজধানীর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বায়ুদূষণ আরও বাড়ে।
“সাভারকে ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষণা করা হলো একটি সতর্কবার্তা,” বলেন একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। “এখানে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে।”
দূষণের প্রধান উৎস
সাভারে বায়ুদূষণের বড় উৎস হলো ইটভাটা। ২০২৩ সালে স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণের ২৮ শতাংশ দায়ী ইটভাটার ওপর।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোট ৭,০৮৬টি ইটভাটা আছে, যার মধ্যে ৪,৫০৫টিরই পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। গত চার বছরে প্রায় ১,৫০০ অবৈধ ইটভাটা বেড়ে গেছে। যদিও ডিওই অভিযান চালিয়ে প্রায় ১,০০০ অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করেছে, সেগুলোর প্রায় ৭৫ শতাংশ পুনরায় চালু হয়েছে।
অধিকাংশ ইটভাটা নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করে, যা বছরে ঢাকার চারপাশে প্রায় ৫৩,০০০ টন PM10 এবং ১৭,০০০ টন PM2.5 নিঃসরণ করে। সাভারে ১০৭টি ইটভাটা রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র দু’টিতে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, দূষিত বায়ুর কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ছয় বছর আট মাস কমছে। IQAir-এর ২০২৪ সালের বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ দেশের মধ্যে দ্বিতীয় এবং ঢাকা শহর বিশ্বের তৃতীয় সবচেয়ে দূষিত নগরী।
সাভার কেন ডিগ্রেডেড এয়ারশেড?
ডিওই-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সাভারে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ১৬৪ দিন বায়ুর মান নিরাপদ সীমার বাইরে ছিল। ঢাকায় সেই সংখ্যা ছিল ১৫৬ দিন। ২০২৪ সালে সাভারের দূষিত দিন ছিল ১৪৯, ঢাকার ১২৮ দিন।
ডিওই-এর পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপনা) মো. জিয়াউল হক বলেন, “শুষ্ক মৌসুমে সাভারের দূষণ ঢাকার দিকে চলে আসে। এ কারণেই সাভারকে ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষণা করা হলো।”
পরবর্তী পদক্ষেপ
বিধিমালা অনুযায়ী, ডিগ্রেডেড এয়ারশেড ঘোষণা হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট এলাকার বায়ুমান উন্নয়নের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সাভারে এই পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত:
- সেপ্টেম্বর থেকে টানেল ও হাইব্রিড হফম্যান কিলন ছাড়া অন্যান্য সব ইটভাটা বন্ধ।
- উন্মুক্ত স্থানে কঠিন বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ।
- নতুন দূষণকারী শিল্পের অনুমোদন স্থগিত।
জিয়াউল হক বলেন, “নতুন কোনো শিল্প যে সাভারে বায়ুদূষণ সৃষ্টি করবে, তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না। ধাপে ধাপে সব ইটভাটা বন্ধ করা হবে।”
সরকারের চ্যালেঞ্জ
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার মন্তব্য করেন, “এটি দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যে কোনো এলাকা দূষিত হিসেবে সরকার স্বীকার করেছে। পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।”
পরিষ্কার আকাশের জন্য প্রথম পদক্ষেপ
সাভারের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এটি অন্যান্য দূষিত এলাকায় নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের পথ খুলবে। বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জ থাকলেও এটি শহর ও গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষায় একটি সাহসী প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে।