রাতারগুল রক্ষায় গ্রামবাসীর অঙ্গীকার: টেকসই পরিবেশের বাস্তব উদাহরণ
বাংলাদেশের একমাত্র মিঠাপানির জলাবন রাতারগুল। সিলেটের গোয়াইনঘাটে অবস্থিত এই বন দেশের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের অনন্য সম্পদ। হিজল-করচে ঘেরা বনের ভেতর দিয়ে নৌকা ভ্রমণ করতে করতে পর্যটকেরা মুগ্ধ হয়ে যান প্রকৃতির অপূর্ব সমন্বয়ে।
বর্ষা এলে রাতারগুল হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ যৌবনের আধার, যা দেশ-বিদেশ থেকে আগত পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তবে সৌন্দর্যের এই ভান্ডারকে টিকিয়ে রাখা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। চারপাশের অধিকাংশ পর্যটনকেন্দ্র যখন নির্বিচারে বালু ও পাথর লুটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তখন রাতারগুলকে রক্ষা করেছে এখানকার সাধারণ মানুষ, যারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রমাণ করেছেন স্থানীয় জনগণ চাইলে প্রাকৃতিক সম্পদকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
মাত্র কয়েক মাস আগের একটি ঘটনাই এ কথা স্পষ্ট করে। কয়েকজন ব্যক্তি অবৈধভাবে বনের ভেতরে বালু তুলতে শুরু করলে গ্রামের মানুষ ছুটে গিয়ে তাদের আটক করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। এটি ছিল স্থানীয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগের প্রতীক। গ্রামবাসী বুঝে গেছেন, বনকে রক্ষা করতে হলে নিজেদেরই দায়িত্ব নিতে হবে।
তাই তারা শুধু বালু উত্তোলন রোধেই থেমে থাকেননি, মাছ শিকার, গাছ কাটা কিংবা পাখি নিধনের মতো কর্মকাণ্ড বন্ধ করতেও নিজেরাই নজরদারি শুরু করেছেন। রাতারগুল এবং এর সংলগ্ন নদীতে কেউ যেন অবৈধভাবে বালু না তুলতে পারে, সে জন্য বিশেষভাবে পাহারা বসানো হয়েছে। গ্রামের নৌকামালিক থেকে শুরু করে তরুণ-যুবক, এমনকি প্রবীণরাও এ কাজে সমানভাবে যুক্ত হয়েছেন।
এই সচেতনতার ফলে রাতারগুল এখনো তার প্রাকৃতিক রূপ ধরে রেখেছে। যখন জাফলং, সাদাপাথর, বিছনাকান্দি কিংবা লোভাছড়ার মতো কেন্দ্রগুলোতে সৌন্দর্য ম্লান হয়ে পর্যটকের ভিড় কমে গেছে, তখন রাতারগুলে প্রতিদিনই হাজারো মানুষ ভিড় করছেন।
পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের তুলনায় এ বর্ষায় এখানে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে। অর্থাৎ প্রকৃতি রক্ষার সরাসরি ফল স্থানীয়রা হাতেনাতে পাচ্ছেন। পরিবেশ অক্ষত থাকলে পর্যটন টিকে থাকে, আর পর্যটন টিকে থাকলে গ্রামীণ অর্থনীতি লাভবান হয়।
গ্রামের বাসিন্দারা শুধু অবৈধ কর্মকাণ্ড ঠেকিয়েই ক্ষান্ত হননি, তাঁরা বনের সৌন্দর্য ধরে রাখতে নিয়মিত পরিচ্ছন্নতামূলক কাজও করছেন। অনেক সময় পর্যটকেরা প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট বা অন্যান্য বর্জ্য ফেলে দেন, যা পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এ সমস্যা সমাধানে স্থানীয় একটি সমাজকল্যাণ সংগঠন সাপ্তাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে এসব বর্জ্য অপসারণ করে। এভাবে বন শুধু সংরক্ষিতই হচ্ছে না, বরং তার সৌন্দর্যও অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হচ্ছে।
এই প্রচেষ্টা বিশ্ববাসীর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ছাড়া স্থায়ী কোনো সমাধান সম্ভব নয়—এই সত্য রাতারগুলের মানুষ স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বের বহু দেশে বন সংরক্ষণের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে কেবল জনগণের অংশগ্রহণ না থাকার কারণে।
অথচ রাতারগুলের গ্রামবাসী দেখিয়েছেন, ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এ অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন অর্জনের পথে এক মূল্যবান উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
রাতারগুলের ঘটনাটি দেশের অন্যান্য এলাকায়ও অনুপ্রেরণা জাগাতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। হাওর-বাঁওড়, নদী-খাল এবং বনভূমি রক্ষা না করতে পারলে এ দেশের পরিবেশের ভারসাম্য টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
স্থানীয় জনগণ যদি রাতারগুলের মতো সচেতন হয়, তবে জাতীয় পর্যায়েও প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষার আন্দোলন জোরদার হবে। একই সঙ্গে এটি সবুজ অর্থনীতি ও পরিবেশবান্ধব পর্যটনের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
অবশেষে বলা যায়, রাতারগুল শুধু একটি জলাবন নয়, বরং এটি স্থানীয় জনগণের ঐক্য, সচেতনতা ও দায়িত্ববোধের প্রতীক। এখানে যে গণঐক্য গড়ে উঠেছে, তা বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে।
টেকসই উন্নয়নের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এ ধরনের উদ্যোগ বাড়াতে হবে। যদি প্রতিটি গ্রাম তার নিজস্ব সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব নিজেরা নেয়, তবে দেশজুড়ে প্রকৃতি সংরক্ষণের এক নতুন অধ্যায় শুরু হবে, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সবুজ ও নিরাপদ বাংলাদেশ উপহার দিতে সক্ষম হবে।