জলবায়ু মোকাবেলায় মালদ্বীপে হচ্ছে ভাসমান শহর
ভারত মহাসাগরের বিস্তৃত জলরাশির ওপর জেগে উঠছে এক শহর। মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে নৌকায় ১০ মিনিটের দূরত্বে, ফিরোজারঙা এক হ্রদের ওপর নির্মাণাধীন এই শহরে থাকতে পারবেন ২০,০০০ মানুষ। আর সবচেয়ে বড় চমক হলো, পুরো শহরটাই হবে ভাসমান।
উপর থেকে ব্রেইন কোরালের মতো দেখতে এই শহরে থাকবে ৫০০০ ভাসমান বাড়ি, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট এবং বিদ্যালয়। আর এগুলোর মধ্যে দিয়েই বয়ে যাবে ছোট ছোট খাল। মালদ্বীপের এই আশ্চর্য শহর দেখার জন্য খুব বেশিদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে না বিশ্বকে।
চলতি মাসেই শহরের প্রথম একটি ইউনিট উন্মোচিত হবে এবং ২০২৪ সালের শুরুর দিকে বাসিন্দারা এখানে থাকা শুরু করবেন। আর পুরো শহরের নির্মাণকাজ শেষ করতে লেগে যাবে ২০২৭ সাল।
প্রপার্টি ডেভেলপার ডাচ ডকল্যান্ডস এবং মালদ্বীপ সরকারের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হচ্ছে এই ভাসমান শহর। কিন্তু কোনো বিলাসব্যসন বা ভবিষ্যতের মডেল হিসেবে নয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ার মতো নির্মম বাস্তবতার সাথে মোকাবিলা করতেই নির্মাণ করা হচ্ছে শহরটি।
১১৯০টি ছোট-বড়, নিচু দ্বীপ মিলিয়ে গঠিত দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকা দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। দেশটির আশি ভাগেরও বেশি স্থলভাগ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১ মিটার উপরে। এই শতকের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরো এক মিটার বেড়ে গেলে সমগ্র মালদ্বীপই পানির নিচে ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কিন্তু যদি ভাসমান শহর নির্মাণ করা হয়, তাহলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এটিও উপরেই ভেসে থাকবে। তাই মালদ্বীপের ৫ লাখ মানুষের জন্য নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে এ শহর, জানান শহরটির নকশাকারক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়াটারস্টুডিও’র প্রতিষ্ঠাতা কোয়েন অলথুইস।
তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে পানির উপর ভাসমান শহরও নিরাপদ। এখানেও সুলভ মূল্যে বাড়ি মিলবে এবং অনেক মানুষও থাকতে পারবে। মালদ্বীপ ভবিষ্যতে জলবায়ু শরণার্থী নয়, বরং জলবায়ু উদ্ভাবক হিসেবে পরিচিত হবে।’
ভাসমান স্থাপত্যের প্রাণকেন্দ্র
নেদারল্যান্ডসে জন্ম ও বেড়ে ওঠা স্থপতি অলথুইসের জীবন কেটেছে পানির সঙ্গে মিতালি করে। কারণ তার জন্মভূমি নেদারল্যান্ডসের এক-তৃতীয়াংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের চেয়েও নিচু। মায়ের দিক থেকে অলথুইসের পরিবার ছিল জাহাজ নির্মাণের সাথে যুক্ত এবং বাবার দিক থেকে প্রকৌশলী ও স্থপতি। তাই দুটি মিলিয়েই ‘ওয়াটারস্টুডিও’ প্রতিষ্ঠা করা যেন অলথুইসের ভাগ্যের লিখন ছিল! তার এই প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র পানির উপর ভবন নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত।
তবে অলথুইস জানান, আগেও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা ছিল, কিন্তু বর্তমানের মতো এত প্রকট হয়ে ওঠেনি যে শুধুমাত্র ভাসমান ভবন নির্মাণকে কেন্দ্র করেই একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো যায়। সেসময় মূল সমস্যা ছিল জায়গার সংকট। শহরগুলো বিস্তৃত হচ্ছিলো, কিন্তু সেগুলোকে ধারণ করার মতো জায়গা ফুরিয়ে আসছিলো।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন একটি মূল অনুঘটক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ভাসমান স্থাপত্যই এখন মূলধারায় চলে আসছে আস্তে আস্তে, বলেন অলথুইস। তার প্রতিষ্ঠান ওয়াটারস্টুডিও, এ যাবত ৩০০ ভাসমান বাড়ি, অফিস, স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
আর এ উদ্যোগের একটি মূল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে নেদারল্যান্ডস। দেশটিতে একটি ভাসমান পার্ক, ডেইরি ফার্ম ও অফিস ভবন রয়েছে এবং এটি গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশন (জিসিএ)- এর সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বিভিন্ন সমাধান বের করতে কাজ করে এই সংস্থা।
রিইনস্যুরেন্স এজেন্সি ‘সুইস রে’- এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছর শুধুমাত্র বন্যার ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে ৮২ বিলিয়ন ডলার। ওয়ার্ল্ড রিসোর্সেস ইনস্টিটিউট এর অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি শহুরে সম্পদ বার্ষিক উপকূলীয় ও নদী বন্যা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।