ইটভাটার ধোয়ায় হুমকির মুখে কুষ্টিয়া ও পাবনার প্রাণ-প্রকৃতি
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় ৫৫টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে শুধু লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নেই রয়েছে ৪৫টি। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই এসব ভাটায় পুরোদমে চলছে ইট তৈরির কাজ |
ইট তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় মাটি। কয়লা দিয়ে ইট পোড়ানোর নিয়ম থাকলেও অধিকাংশ ইটভাটার মালিকরা সেটি মানছেন না। বনের গাছ পুড়িয়ে প্রস্তুত করছেন ইট। বছরে পাঁচ থেকে ছয় মাস শুষ্ক মৌসুমে দেশে ইট উৎপাদন হয়। বাকি মাসগুলোয় কার্যক্রম অনেকটা বন্ধ থাকে।
শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই কুষ্টিয়া ও পাবনায় ইটভাটাগুলোয় পুরোদমে চলছে ইট তৈরির কাজ। জেলা দুটিতে ৩৯১টি ভাটা রয়েছে। যার মধ্যে ইট উৎপাদনের বৈধতা রয়েছে মাত্র ৪৫টির। ৩৪৬টিরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। এর মধ্যে পাবনার একটি ইউনিয়নেই রয়েছে ৪৫টি ভাটা।
এসব ভাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি। পদ্মার পাড় ও তলদেশ থেকেও সংগ্রহ করা হয় মাটি ও বালি। শুষ্ক মৌসুমে একদিকে বায়ুমণ্ডলে ধুলাবালির প্রাদুর্ভাব, অন্যদিকে ইটভাটার কালো ধোঁয়া অঞ্চল দুটির প্রাণ-প্রকৃতি আরো ঝুঁকিতে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশের সঙ্গে ভারসাম্যহীন এসব ইটভাটা এরই মধ্যে নদী ও কৃষি, জীববৈচিত্র্য ও প্রকৃতির ক্ষতি করে ফেলেছে। এর বাইরেও ভাটাগুলোয় কাঠ পুড়িয়ে উজাড় করা হচ্ছে ফলদ ও বনজ সম্পদ।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক বিপুল রায় বলেন, ‘ইটভাটার ভোগান্তি কিছু ক্ষেত্রে হাতে হাতে ও কিছু ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে তৈরি হয়। স্থায়ী ক্ষতিগুলো খুবই ভয়ংকর।
পদ্মা নদীর তীরজুড়ে কুষ্টিয়া ও পাবনায় যেভাবে ভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে, তাতে নদীর গভীরে স্থায়ী ক্ষত তৈরি হচ্ছে। মাটি ধীরে ধীরে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। যেটা জীববৈচিত্র্যকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।’
কুষ্টিয়া ও পাবনা জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পাবনায় ১৭৩টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে ৩০টির পরিবেশের ছাড়পত্র থাকলেও ১৪৩টি ভাটা চলছে অবৈধভাবে। অন্যদিকে কুষ্টিয়ায় ২১৮টি ভাটার মধ্যে অনুমোদিত মাত্র ১৫টি। বাকি ২০৩টি চলছে পরিবেশের ছাড়পত্র ছাড়াই।
পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার লক্ষ্মীকুণ্ডা ও সদর উপজেলার হেমায়েতপুরে রয়েছে বেশির ভাগ ইটভাটা। ঈশ্বরদীতে রয়েছে ৫৫টি। এর মধ্যে লক্ষ্মীকুণ্ডা ইউনিয়নেই ৪৫টি ইটভাটা রয়েছে।
ইউনিয়নটির পদ্মার তীরবর্তী দাদাপুর, কামালপুর, বিলকেদার, বাবুলচরসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে এসব ভাটা। হেমায়েতপুরে রয়েছে ৪৬টি ভাটা। এ ১০১টি ভাটার মধ্যে অনুমোদন রয়েছে মাত্র ৮টির।
পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. জামাল উদ্দীন বলেন, ‘একটি ভাটায় কমপক্ষে ৪০ বিঘা জমি ব্যবহার হচ্ছে। ভাটার প্রধান উপকরণ মাটি। এক-একটি ভাটায় যদি ১০ ইঞ্চি পরিমাপের ২০ লাখ করে ইট তৈরি হয়, তাহলে এ দুই এলাকার ১০১ ভাটাতেই মাটি প্রয়োজন হবে ২ লাখ ২৬ হাজার টন।
কিন্তু এত মাটির আলাদা উৎস নেই। ভাটা মালিকরা তাই পদ্মার মাটি সংগ্রহ করছেন। কখনো পদ্মার পাড় কেটে, কখনো তলদেশ থেকে মাটি তুলে নিচ্ছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার কৃষিজমি থেকেও সংগ্রহ করছে মাটি।’
শুধু যে ইটভাটায় সরবরাহের জন্য ফসলি জমির মাটি নেয়া হচ্ছে তা নয়, নদী ও খাস জমি থেকেও প্রতিদিন শত শত ট্রাক-ট্রাক্টর মাটি সরবরাহ হচ্ছে।
নদী এলাকার মধ্যে যেকোনো ধরনের মাটি উত্তোলন আইনত নিষিদ্ধ। এজন্য পাবনায় রয়েছে নৌ পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট। তবে নৌ পুলিশ এ বিষয়ে নীরব ভূমিকা পালন করে বলে দাবি করেছেন এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীকুণ্ডা নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আকিবুল ইসলাম জানান, গত এক মাসে মাটি কাটার কাজে নিয়োজিত সাত শ্রমিককে ১৫ দিন করে জেল ও ১ লাখ ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তার পরও ইটভাটায় মাটি সরবরাহ বন্ধ হয়নি।
তবে ইটভাটা বন্ধ করার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর যথেষ্ট নয়। কারণ ভাটা অনুমোদন বা বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারি আরো কয়েকটি দপ্তরের সহযোগিতা প্রয়োজন হয় বলে জানিয়েছেন পাবনা পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল গফুর।
তিনি বলেন, ‘এক পরিবেশ অধিদপ্তর কোনো কাজে আসছে না। আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান অবৈধ ভাটা বন্ধ করে দেয়া বা না দেয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।’
এদিকে কুষ্টিয়ার ছয়টি উপজেলায় ১২০ ফুট উচ্চতার পাকা ফিক্সড চিমনির ৯৬টি, জিগজ্যাগ ৬৫টি ও ৩০-৪০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন ড্রাম চিমনির ৪১টিসহ ২০৩টি লাইসেন্সবিহীন ইটভাটা রয়েছে। চলতি মৌসুমের শুরুতেই কৃষিজমি ও নদীর পলি মাটি কেটে ভাটাগুলোয় প্রস্তুত করা হচ্ছে নতুন ইট।