জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষিজমিতে লবণাক্ততা বেড়েছে ৬ গুণ
উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর কৃষিজমিতে লবণের স্বাভাবিক মাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি অব স্যালিনিটি (ডিএস)। সেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকার কৃষিজমিতে ২৫ ডিএস মাত্রায় লবণের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে, যা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। ২০২২ সালেও এসব এলাকায় লবণাক্ততার মাত্রা ছিল মাত্র ৪ দশমিক ১ ডিএস। সে হিসাবে গত তিন বছরে লবণাক্ততা বেড়েছে প্রায় ছয় গুণের বেশি।
অন্যদিকে চলতি বোরো মৌসুমে জেলার উপকূলীয় এলাকার বহু সংখ্যক বোরো চাষি ক্ষতিগ্রস্ত জমিতে উচ্চমাত্রার লবণের কারণে। এসব কৃষক বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
কালীগঞ্জ উপজেলার কামারগাতি গ্রামের বোরো চাষি মো. ফজর আলী জানান, চলতি ২০২৪-২৫ মৌসুমে দশ বিঘা পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ করেছেন।
কিন্তু জমিতে অতিমাত্রার লবণের কারণে বোরো ধানের কাক্সিক্ষত উৎপাদন ব্যাহত হবে। ক্ষেতের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ধান গাছ লবণের কারণে শুকিয়ে গেছে। ফলে ধানে চিটা হয়েছে বেশি।
একই উপজেলা কৃষক অমল কুমার জানান, চলতি মৌসুমে ৮ বিঘা পরিমাণ জমিতে বোরো চাষ করেছেন। কিন্তু জমি ও পানিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ থাকায় ধানে ফলন ভালো হয়নি।
তিনি বলেন, বীজতলা থেকে শুরু করে কর্তন পর্যন্ত ৮ বিঘা জমির বোরা চাষে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হবে তার। কিন্তু ক্ষেতে ধানের যে অবস্থা তাতে খরচের অর্ধেক উঠবে কি না, তা নিয়েও সংশয়ে রয়েছেন তিনি।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট সাতক্ষীরা আঞ্চলিক কার্যালয়ের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. সাজ্জাদুর রহমান বলেন, উপকূলীয় এলাকার অধিকাংশ কৃষি জমিতে মাত্রারিক্ত লবণ দেখা দিয়েছে।
এর মধ্যে জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার খাজাবাড়িয়া এলাকার বোরো চাষের জমিতে সর্বোচ্চ ২৫ ডিএস পর্যন্ত লবণ পাওয়া গেছে। তাছাড়া ভূগর্ভের পানিতে লবণের উপস্থিতি আরও বেশি বলে জানান তিনি।
ফলে ২০২৪-২৫ মৌসুমে বোরো ধান গবেষণা প্রকল্পের অধীনে ওই লবণ এলাকাতে পরীক্ষামূলক বিভিন্ন ধান চাষ করা হলেও তাতে আশানুরূপ ফলন হয়নি বলে জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, অতিমাত্রার লবণের কারণে উপকূল এলাকার ধান গবেষণা প্রকল্পের অধীনে প্রদশর্নী মাঠের অধিকাংশ বোরো ধানের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। লবণের কারণে শুকিয়ে গেছে বোরো ক্ষেতের ধানের গাছ।
তবে ওই সব লবণাক্ত এলাকাগুলোয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত লবণসহিঞ্চু ধানের জাত যেমন ব্রি-ধান ৬৭, ৯৯, ৬৩ ও ১০৮ চাষ করার জন্য পরামর্শ দেয়া হচ্ছে কৃষকদের।
শুধু ধান গবেষণা প্রকল্পের মাঠ নয়, জেলার উপকূলীয় কালীগঞ্জ, দেবহাটা, আশাশুনি ও শ্যামনগর উপজেলার অসংখ্য বোরো চাষি ক্ষতিগ্রস্ত, জমিতে অতিমাত্রার লবণের কারণে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা জেলার সহকারী পরিচালক সরদার শরীফুল জানান, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি উজান থেকে মিষ্টি পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর জমিতে লবণাক্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে এ সাতক্ষীরা অঞ্চলের কৃষিতে।
তিনি বলেন, ক্রমাম্বয়ে লবণাক্তা বৃদ্ধি পেলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে সাতক্ষীরা অঞ্চলে পরিবেশের যেমন মারাত্মক বিপর্যয় ঘটবে তেমনি, ফসল উৎপাদনেও মারাত্মক ক্ষতি হবে। তবে এই ভয়াবহ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে এক্ষণে বেশি করে বৃক্ষরোপণ, পুকুর ও জলাশয় তৈরি করার কোনো বিকল্প নেই।