যুদ্ধ ও পরিবেশ: এক নীরব বিপর্যয়ের দীর্ঘ ছায়া
বিশ্লেষণধর্মী ফিচার
যুদ্ধকে আমরা সাধারণত দেখি মানুষের রক্তপাত, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর সীমান্ত লঙ্ঘনের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এই দৃশ্যপটের বাইরেও যুদ্ধ রেখে যাচ্ছে আরও গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত—প্রকৃতির বুকে। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল, নদী, পাহাড়, প্রাণীজগৎ, এমনকি মানুষের নিজস্ব জীবিকাও। যুদ্ধ যেন এক নিঃশব্দ পরিবেশ হত্যাকাণ্ড, যার ফল ভোগ করতে হয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে।
আধুনিক অস্ত্রের প্রকৃতি-বিধ্বংসী ক্ষমতা
যুদ্ধ আজ আর শুধু কামান ও বন্দুকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আজ রাসায়নিক, জৈব, নিউক্লিয়ার এবং উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর। এইসব অস্ত্র শুধু জীবনের উপরেই আঘাত হানে না, প্রাকৃতিক পরিবেশকেও করে তোলে বিষাক্ত। ধরা যাক ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা। মার্কিন বাহিনী ‘Agent Orange’ নামক রাসায়নিক ছড়িয়ে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ অরণ্যে, যার ফলে বহু গাছপালা ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয় এবং মানবদেহে জন্ম নেয় বহু জিনগত ত্রুটি। একই চিত্র দেখা গেছে ইরাক যুদ্ধ কিংবা সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে।
যুদ্ধকালে বনভূমি উজাড় ও ভূমিক্ষয়ের হার
১৯১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘটিত ১৯৩টি যুদ্ধ পরিস্থিতি বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অরণ্য (৩৪%) ও ভূমি (২৩%)। বিস্ফোরণ ও রাসায়নিক অস্ত্রের মাধ্যমে শুধু গাছই নয়, উজাড় হয়েছে পুরো বাস্তুতন্ত্র। ভেঙে পড়েছে মাটি ও জলের প্রাকৃতিক চক্র। প্রাকৃতিক উৎসগুলো যেমন নদী, জলাভূমি ও পাহাড় যুদ্ধের মুখে দাঁড়িয়ে হারিয়েছে তাদের অস্তিত্ব। ফলে স্থানীয় মানুষ হারিয়েছে তাদের কৃষিকাজ, মৎস্য আহরণ ও বননির্ভর জীবিকা।
যুদ্ধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র
যুদ্ধবিষয়ক নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষা করে এসেছেন যে, যুদ্ধ জলবায়ু পরিবর্তনের একটি বড় উৎস। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত অস্ত্র, যানবাহন ও পরিকাঠামোর কারণে উৎপন্ন হয় বিপুল পরিমাণ গ্রিনহাউস গ্যাস। অন্যদিকে ধ্বংস হয়ে যায় বনাঞ্চল ও জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প প্রাকৃতিক সমাধানগুলো। এতে গড়ে ওঠে এক দ্বিমুখী সংকট—জলবায়ুর দুর্যোগ বাড়ে এবং তার মোকাবিলায় থাকা প্রাকৃতিক সম্পদও নষ্ট হয়ে যায়।
জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত সংকট: গাজা ও ইউক্রেনের উদাহরণ
মাত্র তিন মাসের ইসরায়েলি হামলায় গাজা উপত্যকায় ৫ বছরের কম বয়সী প্রায় ১.৮ লক্ষ শিশু আক্রান্ত হয়েছে মারাত্মক শ্বাসকষ্টে, এবং ১.৩ লক্ষ শিশু ডায়রিয়ায়—যার মূল কারণ যুদ্ধজনিত পরিবেশ দূষণ।
অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধে, ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৩০ লক্ষ হেক্টর অরণ্য, যার মধ্যে ১০ লক্ষ হেক্টর সংরক্ষিত বন। হাজার হাজার বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে।
ড. বোহদান ভাইকো বলেন, “আমরা প্রকৃতির এমন কিছু অংশ চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি, যা আর কখনো ফিরে আসবে না।”
অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে যুদ্ধ
গ্রিক দার্শনিক জেনো বলেছিলেন, “জীবনের লক্ষ্য প্রকৃতির সঙ্গে চুক্তি করে জীবন যাপন করা।” কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ও বিদ্রোহী গোষ্ঠী সেই চুক্তির তোয়াক্কা না করেই যুদ্ধের মাধ্যমে প্রকৃতির বিরুদ্ধে এক নির্মম আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে গার্ডিয়ান-এর চিত্রগ্রাহক ও দুইবারের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো বিজয়ী আলেসিও ম্যামো বলেন—
“War is the ultimate form of human violence against nature.”
তিনি তাঁর ক্যামেরায় বন্দী করেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম এশিয়া, বলকান ও ইউক্রেনের সেই সব ছবি, যেখানে মানুষ যেমন নিহত, তেমনি প্রাণহীন হয়ে গেছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
উপসংহার: শান্তি কেবল অস্ত্রনিরোধে নয়, প্রকৃতি রক্ষাতেও
যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির কথা আজ বিশ্বজুড়ে উঠছে। কিন্তু প্রকৃত শান্তি তখনই সম্ভব, যখন তা মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক নির্ভরতাকে সম্মান জানায়। যুদ্ধ শুধু রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয় নয়, এটি এক পরিবেশগত দুর্যোগ। তাই যুদ্ধবিরোধী যে কোনো আন্দোলন, শান্তির যে কোনো বার্তা—তা যেন পরিবেশ রক্ষার অঙ্গীকারও বহন করে।
আমরা যদি সত্যিই এই পৃথিবীকে আগামী প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে তুলতে চাই, তবে যুদ্ধ নয়, প্রয়োজন প্রকৃতি ও মানবতার এক যৌথ চুক্তি।
আনন্দ বাজার.com এ ২রা মে,২০২৫ তারিখে প্রকাশিত কলকাতার সাংবাদিক, মালবী দত্তের লেখা হতে অনু লেখন।অনুলেখন করেছেন জনাব দীপক jsmfv কুন্ডু।