স্কটল্যান্ডের জোয়ার ভাটার বিদ্যুৎ প্রকল্প (Tidal Energy Project) বিদ্যুৎ উৎপাদনে সম্প্রতি মাইল ফলক স্পর্শ করেছে, আমরা কি ভাবছি?
সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত টারবাইন (Turbine) স্থাপন করে জোয়ার ভাটার পানি প্রবাহ কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে স্কটল্যান্ড তার প্রাকৃতিক সৌন্দয্যকে সংরক্ষণ করার পরিকল্পনা করছে। স্কটল্যন্ডের উত্তর সমুদ্র উপকুলে সাগর তলদেশে স্থাপিত ৪ টি টারবাইনের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ২০১৯ সাালে উপকুল বর্তী ৪০০০ টি বাড়িতে নিরবিছিন্ন ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ সম্পন্ন করেছে।
একটি সামুদ্রিক চ্যানেলের তলদেশে টারবাইনসমূহ এমন ভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা জোয়ার ভাটার উভয়মূখী পানির স্রোতকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এ প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে স্কটল্যান্ড তার ভবিষ্যত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে।
স্কটল্যালেন্ডের উত্তর সমুদ্র উপকুলে সাগর তলদেশে স্থাপিত প্রকৌশলের বিশাল কীর্তি সবেমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদনে মাইলফলক স্পর্শ করেছে।
বিশাল দৈত্য আকৃতির টারবাইনগুলোতে প্রাথমিক শক্তি হিসাবে ভবিষ্যতে বাতাস কলে উৎপাদিত শক্তি (Wind Energy) ব্যবহার করা হবে। স্কটল্যান্ডের লক্ষ্য ২০২০ সালে ১০০% নবায়যোগ্য (Renewable) বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ইতোমধ্যে ইইউভূক্ত ১১ টি দেশ ১০০% নাবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য স্থাপন করেছে।
সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জোয়ার ভাটার বহু মেঘাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন স্কটল্যান্ডের বিদ্যুৎ প্রকল্পটির নাম মে জেন (Meygen) যা দীর্ঘতম সময় ধরে নিরবিছিন্নভাবে সমুদ্র উপকুলের ৪০০০টি বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করেছে- তা নিরবিছিন্নভাবে বিদ্যুঃ সরবরাহে বিশ্বের এক অনন্য রেকর্ড।
জোয়ার ভাটা চালিত উক্ত ৪টি দৈত্য আকৃতির বিদ্যুৎ টারবাইন এখন স্কটল্যান্ডের জাতীয় বিদ্যুত গ্রীডে পরীক্ষা মূলকভাবে ২৪.৭০ গিগাওয়াট ঘন্টা (GWh) বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
স্কটল্যান্ডের উপকূলীয় ঘন বসতিপূর্ণ এলাকার ১,৭৫,০০০ টি বাড়ীতে নিরবিছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করার লক্ষ্যে সমুদ্রের তলদেশে স্থাপিতব্য মোট ২৫০ টি বিদ্যুৎ টারবাইনের ইহা ১ম পর্যায়।
সমুদ্রের তলদেশে বিন্যস্ত টারবাইনগুলো স্কটল্যান্ডের মুল ভূখন্ডের বাহিরে স্ট্রমা দ্বীপের প্রাকৃতিক সমুদ্র চ্যানেলের তলদেশে বসানো হয়েছে, যেথায় জোয়ার- ভাটাকালীন আটলান্টিক মহাসাগর ও উত্তর সাগরে সমুদ্র স্রোত প্রবাহের সময় স্রোতের গতি বৃদ্ধি পায়।
বিশাল দৈত্য আকৃতির সামুদ্রিক বাতাস কলের ন্যয় পানির স্রোতের প্রবাহের ফলে টারবাইনের রোটর গুলো (Rotors) দ্রুত ঘুরতে থাকে, যেগুলো জেনারেটরকে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
এই কম ভোল্টের বিদ্যুৎ পানির নীচে স্থাপিত টারবাইনগুলোর সাথে সংযুক্ত ও সাজানো বিদ্যুৎ তাওে নেট ওর্য়াক দ্বারা উপকুলের বিদ্যুৎ গ্রীডের সাথে সংয্ক্তু থাকে এবং বেশী ভোল্টেজ এর বিদ্যুতে রুপান্তরিত করে জাতীয় গ্রীডে সরবরাহ করা হয়।
অবশ্য জোয়ার ভাটার বিদ্যুৎ শক্তি (Tidal energy) এর বিষয়টি কিছুকাল পূর্ব হতেই শুরু হয়েছে, ১৯৬৬ সালে প্রথম জোয়ার ভাটায় টারবাইন জেনারেটর স্থাপন করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় এবং তখনই একটি শক্তির উৎস হিসাবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়।
২০১৬ সালে ইউরোপীয় কমিশন হিসাব কষে যে ২০৫০ সালে ইইউতে যে বিদ্যুৎ এর প্রয়োজন হবে – তার ১০% ই সামুদ্রিক ঢেউ এবং সামুদ্রিক জোয়ার ভাটার উৎস হতে সরবরাহ করা হবে। তারও পূর্বে যুক্তরাজ্য হিসাব করে যে, সে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ২০% জোয়ার ভাটায় চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হতে সরবরাহ করা হবে।
এখন প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক যে, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম দূষণ মূক্ত শক্তি উৎপাদনে করছে টা কি?
সবুজ শক্তি হিসাবে জোয়ার ভাটায় বিদ্যুৎ উৎপাদন বিষয়টি অন্যান্য নবায়ন যোগ্য শক্তির মত সূর্যের আলোর প্রাপ্যতা বা বায়ু প্রবাহের উপর নির্ভরশীল নয়। যেহেতু পানির ঘনত্ব বায়ু অপেক্ষা আনেক অনেক বেশী, সেহেতু বায়ু কল (Wind mail) অপেক্ষা অনেক ছোট ছোট টারবাইন সমুদ্রের তলদেশে স্থাপনে সমপরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয় এবং ভূ-ভাগের তুলনা আরও বেশী পাশাপাশিও বসানো সম্ভব হয়।
প্রতেকটি টারবাইন ১২০০ টন ওজনের ৬টি ব্যালাস্টব্লকসহ ২৫০ হতে ৩৫০ টন ওজনের ফাউন্ডেশনের উপর স্থাপন করা হয়। বিশ্বের এমন একটি বিদ্যুৎ উৎস এখনও শৈশবেই রয়ে গেল।



দক্ষিন কোরিয়ার সিহওয়া হৃদ বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং চীনের জিয়াংগিয়া পাইলট জোয়ার ভাটার বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বিশ্বজুড়ে এ ধরনের প্রচুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। তবে অন্যান্য অনেক নবায়নযোগ্য শক্তির উৎসের তুলনায় জোয়ার ভাটার বিদ্যুৎ কেন্দ্র এখনও তুলনামূলক ভাবে শৈশবেই রয়ে গেছে।

আর আমাদের দেশে এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়টি তো এখনও কল্পনাতেই জন্মায়নি। আমাদের আঁকা বাঁকা ও দ্বীপাঞ্চল সমূহের চার দিক মিলেয়ে ৬০০/৭০০ কিমি: (সরাসরি ৪২১ কিমি) সমুদ্র উপকূল, ১,১৮,৮১৩ বর্গকিমি সমুদ্র অঞ্চল ( ২০১৪ সালে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতের রায় অনুযায়ী),
ছোট বড় মিলিয়ে প্রায় ১২০০ নদ-নদীর হাজার হাজার নদীতীর, উজান হতে নেমে আসা অবিরাম পানি প্রবাহ, বন্যার পানির শক্তিধর স্রোতধারা -এত সকল নীল শক্তির উৎস থাকা সত্তেও আমরা নীল শক্তির শৈশবে উপস্থিত হওয়াতো দূরের কথা এখনও ভ্রন সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে সামর্থ হইনি।
তাই আমাদেরকে এখনও আমদনীকৃত কয়লা দিয়ে নীল শক্তির উৎসের স্বর্গরাজ্য মহেষখালীতে সর্বোচ্চ দূষণ ছড়ানোকারী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে হচ্ছে।
অন্যসব পাহাড়ী নদী বাদ দিলেও পাকিস্তান আমলে তৈরীকৃত কাপ্তাই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভাটিতে একাধিক অনুরূপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সম্ভাবনাকেও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি।
এখন প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক যে, আসলে আমাদের প্রকৌশলীরা ও নীতি নির্ধারকেরা কি এসব ভাবছেন?
জোয়ার ভাটার শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক বিনিয়োগ অত্যধিক হলেও পরিচালন ব্যয় তুলনামূলকভাবে একেবারে অত্যন্ত কম, নিরাপদ ও সম্পূর্ণ দূষণমূক্ত।
একদিকে কিয়োটো প্রটোকল, মনট্রিল প্রটোকল ও প্যারিস জলবায়ু চুক্তির স্বাক্ষরকারী দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূণ্য কার্বণ উৎপাদনের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে হবে, অন্য দিকে মূল্যবান বৈদিশিক মুদ্রা ব্যয় করে দূষণ ছড়ানো জীবাষ্মা জ্বালানী তথা ডিজেল, পেট্রোল, কয়লা আমদানী করে বিদ্যুৎ উৎপাদন আর কত দিন?
পরিবেশ দূষণের বিষয়টি জোরালোভাবে বিবেচনা না করলেও শক্তি উৎপাদনে পরনির্ভরশীলতা তো আমাদেরকে ধীরে ধীরে হ্রাস করতে হবে।
জোয়ার ভাটার বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়ে এখনও অনেক প্রশ্নের সুরাহ হয়নি, যেমন ইহা দ্বারা সমুদ্রের তলদেশের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিনা? ইহার শব্দ এবং অবস্থানের জন্য সামুদ্রিক প্রানী কুলের কোন ধরনের ক্ষতি হচ্ছে কিনা এবং হলে কি ধরনের?
কারণ, এমন ধরনের গবেষনা এখনও পর্যাপ্ত নয়। প্রাথমিক গবেষনায় এখনও তেমন ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি, তবে এর জন্য আরও গভীর ও আধুনিক বিঞ্জান ভিত্তিক গবেষনার প্রয়োজনীয়তা এবং কোন ক্ষতিকর কিছু পাওয়া গেলে তা প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা গ্রহন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
Source: World Economic Forum