জলবায়ু পরিবর্তনজনিত গণঅভিবাসন: দক্ষিণ এশিয়ায় ৪০ মিলিয়ন মানুষের স্থানান্তরের শঙ্কা এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যর্থতা
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দুর্যোগের কারণে বিশ্বব্যাপী, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে, গণঅভিবাসন (Mass Migration) এক অনিবার্য মানবিক সংকটে পরিণত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘের পরিবেশগত মূল্যায়ন অনুযায়ী, যদি জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, তবে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এবং নেপাল সহ এই অঞ্চলের উপকূলীয় ও কৃষি-নির্ভর অঞ্চলগুলি থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন (৪ কোটি) মানুষ তাদের আবাসস্থল ছেড়ে অভ্যন্তরীণ বা আন্তঃসীমান্তীয় অভিবাসনে বাধ্য হতে পারে।
এই বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থানচ্যুতি কেবল মানবিক বিপর্যয়ই নয়, বরং এই অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ।
দক্ষিণ এশিয়া ভৌগোলিকভাবে জলবায়ু সংকটের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং তীব্র ঘূর্ণিঝড়, হিমালয় অঞ্চলে হিমবাহ গলে যাওয়া এবং অসময়ে বন্যা, এবং অভ্যন্তরীণ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী খরার কারণে কৃষি উৎপাদন হ্রাস—এই সবগুলো সম্মিলিতভাবে অভিবাসনের কারণ হচ্ছে।
এই জলবায়ু অভিবাসীরা প্রায়শই শহরের বস্তিগুলিতে বা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অঞ্চলে আশ্রয় নেয়, যা এই স্থানগুলিতে সম্পদের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে এবং সামাজিক উত্তেজনা বাড়িয়ে তোলে।
এই সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে বড় বাধা হলো আঞ্চলিক সহযোগিতার অভাব। সার্ক (SAARC)-এর মতো আঞ্চলিক সংস্থাগুলির অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যেকার ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং অন্যান্য আন্তঃদেশীয় রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে জলবায়ু সংক্রান্ত কোনো সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
যদিও দেশগুলির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কিছু প্রচেষ্টা বিদ্যমান, একটি কার্যকরী আঞ্চলিক আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা (Regional Early Warning System), তথ্য আদান-প্রদান এবং যৌথভাবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার কৌশলগুলি বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
একটি কার্যকরী আঞ্চলিক কাঠামো ছাড়া, জলবায়ুজনিত চরম ঘটনাগুলি এককভাবে মোকাবিলা করতে গিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতি দীর্ঘমেয়াদী দুর্বলতার শিকার হচ্ছে।
নীতি বিশেষজ্ঞ এবং পরিবেশ বিজ্ঞানীরা একমত যে, এই নীরব মানবিক বিপর্যয় রোধ করতে হলে আঞ্চলিক দেশগুলির মধ্যে জলবায়ু কূটনীতিকে (Climate Diplomacy) রাজনৈতিক বিরোধ থেকে আলাদা করে ‘রিং-ফেন্সিং’ করা জরুরি।
সীমান্ত পেরিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে সহযোগিতা, জলবায়ু ঝুঁকির তথ্য স্বচ্ছভাবে প্রকাশ এবং জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য একটি আইনি ও মানবিক কাঠামোর বিষয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নেওয়া এখন সময়ের দাবি। এই উদ্যোগগুলিই কেবল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট মানবিক ব্যয় কমাতে সাহায্য করতে পারে।
