জলবায়ু পরিবর্তন উত্তর মেরুকে বিদ্ধস্ত করে দিচ্ছে
– রহমান মাহফুজ এবং রাহিল খান
বিগত ১০/১২/২০১৯ তারিখে একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তর মেরু অঞ্চলের তাপমাত্রা রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি উঠেছে যা উত্তর মেরুর মহাসামুদ্রিক বরফকে দ্রুত গলিয়ে ফেলছে। ফলে এর কারনে আঞ্চলিক খাদ্য জালে ঝুঁকির প্রভাব পড়ছে এবং সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ১৯০০ সালের পর বছরের গড় তাপমাত্রা সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উঠেছিল। যদিও এটি উচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড স্থাপন করতে পারেনি, তবে এটি উদ্বেগজনক, কারন সব মিলিয়ে গত ছয় বছরে এ অঞ্চলে রেকর্ড করা সবচেয়ে উষ্ণতম তাপমাত্রা ছিল এটি।
ডার্টমাউথ কলেজের থায়ার স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (Thayer School of Engineering at Dartmouth College) প্রফেসর এবং সমুদ্রের বরফ সম্পর্কিত প্রতিবেদনের প্রধান লেখক ডোনাল্ড রেপরোভিচ বলেছেন যে, এমন একটি ব্যবস্থা রয়েছে যা আমাদেরকে ক্রমে কঠোর ভাবে কারারুদ্ধ করছে ”
এ ফলাফল উওর মেরু সংশ্লিষ্ঠ প্রতিবেদন থেকে প্রাপ্ত – যা জাতীয় মহাসাগর ও বায়ুমন্ডলীয় প্রশাসন কর্তৃক তৈরীকৃত একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক পর্যালোচনা মূল্যায়ন এবং যা এ অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তণের প্রভাবগুলিকে পর্যবেক্ষণ করে ও প্রাপ্ত অনুসন্ধানগুলি ঐতিহাসিক রেকর্ডের সাথে তুলনা করে।
উত্তর মেরু অঞ্চল নিয়ে গবেষকদের অধিক আগ্রহের কারণ এটি পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার তুলনায় দ্বিগুণ হারে দ্রæত উষ্ণায়িত হয়ে সমুদ্র এবং স্থল উভয় ক্ষেত্রেই দ্রæত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ডাঃ পেরোভিচ বলেছেন, “আমি যদি ছোটবেলায় এ জাতীয় একটি প্রতিবেদন পেতাম তবে আমাকে তখন ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিত, এখন অবস্থা ভিন্ন হতে চলেছে এবং বর্তমানে মোটেও ইহা তেমন উন্নতির দিকে যাচ্ছে না। পরিস্থিতি দিনকে দিন আরও খারাপ হচ্ছে।
জুলাই ২০১৯ মাসে, আইসল্যান্ডের রেইকাজিক অঞ্চল তার উষ্ণতম মাসটি অনুভব করেছিল। একইভাবে গত জুন, জুলাই এবং আগস্টে আলাস্কা, অ্যাংরেজ এলাকাসমূহে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড স্থাপন করেছে। তবে চরম তাপমাত্রা শুধু গ্রীষ্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলনা।
নরওয়ের সোভালবার্ডে ডিসেম্বরের তাপমাত্রা ছিল ১৯৮১-২০১০ সালের তাপমাত্রার গড়ের চেয়ে ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা প্রায় ৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। সায়েন্স অ্যাডভান্সস সাময়িকীতে এ বছরে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, উচ্চ-নির্গমণ দৃশ্যের অধীনে উত্তর মেরু অঞ্চলের কিছু অংশে শরতের শেষের তাপমাত্রা ঐতিহাসিক গড়ের চেয়ে ২৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট উষ্ণতর পৌঁছতে পারে।
প্রতিবেদনটিতে উষ্ণতর তাপমাত্রা প্রতিবেদনের নথিভুক্ত পরিবর্তনগুলিরই একমাত্র নথিভুক্ত করা হয়েছে। গ্রিনল্যান্ডের বরফশীটের পঁচানব্বই শতাংশ ২০১৯ সালে গলেছে, যা স্বাভাবিক ভাবে কিছু দিন পূর্ব হতেই গলে যাওয়া শুরু হয়েছিল। এতে সমুদ্রের পানির স্তর বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান উদ্বেগকে আরও বেশি বাড়িয়ে তুলছে।
১০-১২-২০১৯ এ প্রকাশিত একটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে যে, ১৯৯০ এর তুলনায় গ্রিনল্যান্ডের বরফ সাতগুণ দ্রুত গলে যাচ্ছে, এমন গতিতে গলতে থাকলে শতাব্দীর শেষের দিকে সমুদ্রের স্তর প্রায় তিন ইঞ্চি বৃদ্ধি পাবে।

উত্তর মেরু সমুদ্রের বরফরাশি মেরু অঞ্চলগুলিকে শীতল রাখতে সহায়তা করে এবং বৈশ্বিক আবহাওয়ার প্রভাব গুলোকে সহনীয় রাখে এবং মেরু ভালুকের মতো প্রাণীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল বিরাজমান রাখে। এ বছর কমতে থাকা বরফের স্তর, যা ১৯৭৯ সালে উপগ্রহের রেকর্ড শুরু হওয়ার পর থেকে রেকর্ড হওয়া দ্বিতীয় সর্বনিম্ন গ্রীষ্মের সাথে মিলে যায়।
বিশেষত, বেরিং সাগরে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্যিক মৎসচাষের ক্ষেত্রগুলোতে পর পর দ্বিতীয় শীতেও সামুদ্রিক বরফের অভূতপূর্ব হ্রাস দেখা গেছে। সমুদ্রের বরফ যা আছে তা পাতলা এবং গলে যাওয়ার জন্য আরও সংবেদনশীল হতে থাকে।

চার বছরেরও বেশি সময় ধরে পুরানো বরফটির দ্বারা যেখানে উত্তর মেরু সাগর এর ৩৩ শতাংশ ঢাকা ছিল, এখন সেটি মাত্র ১ শতাংশে। ডাঃ পেরোভিচ বলেছেন, সে সম্পর্কে ভাবার একটি উপায় হল আমরা যখন ১৯৮৫ সালে পুরানো বরফটির সে অঞ্চলটি দেখি তখন এটি মিসিসিপি নদীর পূর্বদিকে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অংশের চেয়ে কিছুটা বড় ছিল।
আর এখন যা কিছু আছে তা মেইন(যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র অংগরাজ্য) এর সমান। সহজে অনুমান করা যায় যে, সমুদ্রের বরফের ক্ষয়টি সাগরের কতটা তাপ পরিবর্তিণ করেছে যার ফলে সামুদ্রিক মৎস্য চাষ এবং বাস্তুতন্ত্র (Ecosystem) প্রভাবিত হয় এবং জলপাতের মত প্রভাব তৈরি করতে পারে।
উষ্ণায়ণের ফলে ঐ সব অঞ্চলের যে সকল নৃগোষ্ঠি আক্রান্ত হয়েছে তারা হল অন্যান্যদের মধ্যে আলাস্কার ইনুপিয়েট, সেন্ট্রাল ইউপিক কাপিক, সেন্ট লয়েন্স দ্বীপ ইউপিক এবং ইউনাঙ্গন জনগোষ্ঠীসহ ৭০ টিরও বেশি আদিবাসী সম্প্রদায় রয়েছে।

প্রতিবেদনের ১৪ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এটিতে কয়েকটি নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টির অর্ন্তভূক্তি ঘটেছে। তারা বলেছিল যে, উষ্ণায়নশীল দেশসমূহের কারণে সৃষ্ট উষ্ণায়ন উত্তর মেরুতে অবস্থিত তাদের খাদ্য উৎপাদনের জায়গা ও যে সকল স্থানে তাদের খাদ্যের সংস্থান রয়েছে সে সকল স্থানে তাদের প্রবেশকে সঙ্কচিত করছে, যা দীর্ঘকাল ধরে তাদের সম্প্রদায়ের বেচেঁ থাকার উপায় ছিল।

বিলম্বিত এবং কম ঠান্ডা জনিত কারণে বছরের শরৎকালের সময় তাদের উৎপাদন মৌসুমেগুলোতে তাদের সম্প্রদায়গুলো একে অন্য হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কারণ তারা এ সময়ে প্রতিবেশী সম্প্রদায়গুলির সাথে যোগাযোগে স্থাপনে পাতলা বরফের জন্য এক দিকে নৌকা ব্যবহার করতে পারে না, অপর দিকে নিরাপদে বরফের উপর দিয়ে যাতায়াতও করতে পারে না।


বর্তমানে সমুদ্রের তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে খাদ্য ঋতু পরিবর্তীত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলসে আলাস্কা নামে একটি ইনুপিয়েট সম্প্রদায় রয়েছে, যারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলেলীয় জনবসতি হিসেবে স্বীকৃত। তারা দাবি করছে যে, একসময় শরৎকালে যে ফসল কাটা হত তা এখন গ্রীষ্মে কাটতে হচ্ছে।

রিপোর্টের অতিথি সম্পাদক এবং ঐ অঞ্চলের ৩৮ টি উপজাতী নিয়ে গঠিত বেরিং সমুদ্র অঞ্চলের বয়স্ক দলের সদস্য মেলিসা জনসন বলেন যে, বেরিং সাগরে যখন বরফগুলো ভেসে আসে সেথায় ৪৮ টি প্রকার খাদ্য, যেমন সাইট্রাস বা আঙ্গুর বা আলু উৎপাদিত হয় – যার উপর আমাদের জীবন জীবিকা নির্ভর করছে, যা এখন ধ্বংস হতে চলেছে”
একইভাবে, পুরো উত্তর মেরুর সম্প্রদায়গুলি পারমাফ্রস্ট (এক প্রকার চির হিমায়িত মাটির অতি পাতলা স্তর) দ্বারা নির্মিত বাড়ীতে বসবাস করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সে স্থলটি এখন ক্রমশ গলে যাচ্ছে এবং এর ফলে রাস্তাগুলি ভেঙ্গে যাচ্ছে ও ঘরগুলি ভেঙ্গে পড়ছে।
উত্তর মেরুর মধ্যে যা ঘটে তা আর উত্তর মেরু মধ্যে থাকে না, পারমাফ্রস্ট দু’ভাবে উষ্ণতার জন্য দায়ী কার্বন ডাই অক্সাইডকে ফাঁদে ফেলে রাখে। যেহেতু, সে স্থলটি গলে যাচ্ছে এবং ফাঁদে আটকানো কার্বণসমূহ বায়ুমন্ডলে চলে যাচ্ছে, যার ফলে জলবায়ু পরিবর্তণকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

গবেষকরা বলছেন, যদি খুব বেশি পারমাফ্রস্ট গলে যায় তবে এটি একটি স্ব-চাঙ্গা চক্র তৈরি করবে যার মধ্যে গলিত পারমাফ্রস্ট সংস্পর্শে আরও বেশী পারমাফ্রস্টের গলানোর কারণ হবে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তণ আরও খারাপ হতে থাকবে।
আলাস্কান পারমাফ্রস্টে কার্বণ প্রবাহের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, সঞ্চিতের চেয়ে বেশি কার্বণ নিঃসৃত হচ্ছে।
ন্যাশনাল স্নো অ্যান্ড আইস ডেটার (National Snow and Ice Data Center) গবেষণা বিজ্ঞানী ম্যাথিউ ড্রাকেনমিলার (Matthew Druckenmiller) বলেছেন “মূল প্রশ্নটি এখনও রয়ে গেছে যে, আলস্কার কয়েক বছরের সময়কালের পরিমাপগুলি উওর মেরুর পরমাফ্রস্টের অন্যান্য অঞ্চলের বিস্তৃত আর্কটিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি কিনা।”
কলোরাডো বোল্ডার বিশ্ববিদ্যালয়ের (University of Colorado Boulder) কেন্দ্র এবং প্রতিবেদনের অন্যতম সম্পাদক বলেছেন “যদি সত্যই এটি হয় তবে আমরা লক্ষণগুলি দেখছি যে, উত্তর মেরু অঞ্চল বাস্তবে জলবায়ু ব্যবস্থার বৃহৎ আকারের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সে ভুমিকা পালন করতে শুরু করেছে।”
Source: New York Times