ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ‘রেসপিরেবল সিলিকা’, এর স্বাস্থ্যঝুঁকি
ঢাকা, বাংলাদেশ – বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বায়ু দূষণের কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। সম্প্রতি, ঢাকা শহরের বাতাসে ক্ষতিকর ‘রেসপিরেবল সিলিকা’ (আরএস) বা অতিক্ষুদ্র ধূলিকণার উপস্থিতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালামের নেতৃত্বে একটি গবেষণায় বায়ুমণ্ডলে রেসপায়ারেবল ক্রিস্টালাইন সিলিকা (RCS) এর উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়েছে, যা শ্বাসযন্ত্রের রোগ, কিডনি সমস্যা এবং এমনকি ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, আরএস হলো এমন ক্ষুদ্রকণা, যাদের আকার ১০ মাইক্রোমিটার বা তার কম। এই কণাগুলো সহজেই শ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং ফুসফুসের গভীরে পৌঁছে গিয়ে বিভিন্ন শ্বাসতন্ত্রের রোগ সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সালামের নেতৃত্বে ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এই গবেষণায় ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আরএসের উপস্থিতি পরিমাপ করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে TSC (টিচার-স্টুডেন্ট সেন্টার) এবং মেরাদিয়া মার্কেটে RCS এর ঘনত্ব স্বাস্থ্যসম্মত সীমার চেয়ে অনেক বেশি। এই ক্ষুদ্র কণা গুলোর প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে নির্মাণ কাজ, ইট ভাটা এবং বর্জ্য পোড়ানোর প্রক্রিয়া।
ডা. আয়েশা আক্তার, শ্যামলীর টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক, জানান, “শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে আরএস শরীরে প্রবেশ করলে সিলিকোসিস, ফুসফুসের ক্যানসার এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগ হতে পারে।” এছাড়া, কিডনির রোগ এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়ার মতো গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
গবেষণায় দেখা গেছে, টিএসসি এলাকায় ক্যানসার-ভিন্ন রোগের ঝুঁকি সর্বনিম্ন ২.৩৭ থেকে সর্বোচ্চ ২.৪৮ এবং ক্যানসারের ঝুঁকি সর্বনিম্ন ২.৭০ থেকে ২.৮৩। মেরাদিয়া এলাকায় এই ঝুঁকি আরও বেশি, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।ঢাকার বায়ু মান সূচক (AQI) প্রায়ই ১৫০ এর উপরে থাকে, যা WHO এর নির্ধারিত স্বাস্থ্যকর সীমার চেয়ে অনেক বেশি। এটি শহরের বাসিন্দাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি করছে।
গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মো. নাজমুল ইসলাম জানান, “ঢাকায় নির্মাণকাজ, যানবাহনের ধোঁয়া, বর্জ্য পোড়ানো এবং অন্যান্য মানবসৃষ্ট কার্যক্রমের ফলে আরএসের মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।” বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ না করলে আরএসের মাত্রা আরও বাড়বে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, ঢাকায় আরএসের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। নির্মাণকাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ, যানবাহনের ধোঁয়া কমানো, বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করা এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন এসব পদক্ষেপের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছেন:
- বায়ু মান মনিটরিং: ঢাকায় বায়ু মান নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য আধুনিক মনিটরিং সিস্টেম স্থাপন।
- নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা: নির্মাণ কাজ, ইট ভাটা এবং বর্জ্য পোড়ানোর ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা।
- সবুজায়ন বৃদ্ধি: শহরে গাছপালা রোপণ ও সবুজ এলাকা বৃদ্ধি করে বায়ু মান উন্নত করা।
ঢাকার বায়ু দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি স্বরূপ। RCS এর উপস্থিতি এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলছে। সরকার, শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা সম্ভব। সতর্কতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ঢাকার বায়ু মান উন্নত করা এবং জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব।
