পোষ্টার আর পোষ্টার, নির্বাচনী পোষ্টার, তার উপর লেমিনিটিং – ঢাকার বিপর্যিত পরিবেশের আরও নাজুকতা
– মিসেস ফাতেমা জিন্নাত
ঢাকা শহরের যে দিকেই এখন চোখ যায় না কেন – শুধু পোষ্টার আর পোষ্টার, নির্বাচনী পোষ্টার, রাস্তা জুড়ে পোষ্টারের এত ছড়াছড়ি, তার উপর অধিকাংশই লেমিনিটিং করা। ঢাকা শহর যেন সাদা কালোর জৌলুস ছড়াচ্ছে। আগামী ১লা ফেব্রুয়ারী ২০২০ তারিখে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনদ্বয়ের একত্রে নির্বাচণ। রাজধানী ঢাকা, তার উপর সিটি কর্পোরেশন এর নির্বাচণ। গনতান্ত্রিক ভাবে ঢাকা শহরবাসীগন তাদের শহরের সেবক নির্বাচিত করবেন।
স্থানীয় নির্বাচন হলেও এখন রাজনৈতিক। দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলসমূহ প্রার্থী দিয়েছে। সুতারাং এ নির্বাচণ যে জাতীয়ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ – তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। গনতান্ত্রিক নির্বাচণে প্রতিযোগিতা মূলক প্রচারনা থাকবেই – এটা গনতান্তিক দেশ হিসাবে আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের। সকল ঢাকাবাসী উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে আগামী ১লা ফেব্রুয়ারী ভোটে অংশগ্রহন করুক, প্রার্থীরা যাতে বিনা বাধায় প্রচার-প্রচারনা চালাতে পারে, দেশের সকল নাগরিকের তা প্রত্যাশা ।
তবে নির্বাচণের নামে এত অপচয়, পরিবেশর এত দূষণ বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিত কোন জাতীর জন্যই প্রত্যাশিত হতে পারে না। এত পোষ্টার – এত কাগজের ছড়াছড়ির কি প্রয়োজন রয়েছে? ভোটদাতাগণ যাতে জানতে পারে, চিনতে পারে, তাদের সেবক হতে চায় কে কে এবং তাদের কার কি যোগ্যতা রয়েছে এবং নির্বাচিত হলে কে কি ধরণের সেবা কিভাবে দিবেন-তা শুধু তাদেরকে অবগত করার ব্যবস্থা করা- প্রার্থীগণের দায়িত্ব।
তার জন্য এতো পোষ্টারের প্রয়োজন কেন? একই দড়িতে গাঁথা, একই স্থানে একাধিক দড়ির পর দড়িতে গাঁথা প্রার্থীর ছবি ও মার্কা সম্বলিত পোষ্টার এর এত প্রয়োজন কি? ভোটের ব্যালোটে তো শুধু প্রার্থীর প্রতীক থাকবে, ছবি নয়। তাহলে এত পোষ্টার এবং কাগজ নষ্ট করার প্রয়োজন কি-তা আবার লেমিনিটিং করে?
পোষ্টারের এত ছড়াছড়ি মানে কাগজ নষ্ট, কাগজ নষ্ট মানে অধিক গাছ কর্তণ ও কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমণ। পোষ্টার ছাপাতে লাগে কাগজ আর কালি, কালিতে থাকে সীসা (Lead) যা বয়স্কদের নানা জটিল রোগের কারণসহ শিশুদের মস্তিস্কের ক্ষতি করে, শিশুদের বিদ্যা-বুদ্ধির লোপ ঘটায়, কোন কোন ক্ষেত্রে শিশুরা সীসার কারণে বোকা ও হাবাগোবা হয়ে যায় – যা জাতীর জন্য তো বটেই পুরো বিশ্ব মানবতার জন্যই ক্ষতিকর।
মনে রাখতে হবে কাগজ উৎপাদনের ব্যবহৃত উপাদানের মধ্যে ৬০% গাছ হতে আসে। যে গাছ আমাদেরকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে এবং আমাদের নির্গত কার্বনডাই অক্সাইডকে খাদ্য রুপে গ্রহন করে এখনও এ পৃথিবীকে মানুষসহ সকল প্রানীর বাসযোগ্য রেখেছে, সে গাছ ধ্বংস যেন মানুষ তার নিজেদের অস্তিত্বের উপরই কুঠার আঘাত করছে। আর প্রতি রিম কাগজ উৎপাদনে প্রায় ৭.৫০ কেজি কার্বনডাই অক্সাইড উৎপাদিত হয় যা বায়ু মন্ডলের নিঃসরিত হয়ে এ পৃথিবীকে উত্তপ্ত করতে সাহায্য করছে, পৃথিবীর তাপমাএা বাড়াচ্ছে।
এর ফলে পৃথিবী জুড়ে সারা বছরই উপর্যুপরি বন্যা, খরা, দাবাদাহ, জলোচ্ছাস, সুনামী, ঘূণিঝড় লেগেই রয়েছে। এ পৃথিবী নামক এ গ্রহটি আজ অস্তিত্বের সম্মুখীন। আমরা এবং আমাদের ভবিষৎ বংশধরেরা এ পৃথিবীতে বেচেঁ থাকতে পারলেই তো তারপর তাদের সেবকের প্রয়োজন হবে, তা না হলে সেবকের দরকার কি?
আর পোষ্টার লেমিনিটিং করা মানে পলিথিন/প্লাস্টিকের ব্যবহার, তাতো পঁচবে না। তা হলে এত লেমিনিটিং পোষ্টারের হবে কি? এ সকল পোষ্টার এখানে সেখানে পড়ে থাকবে, কিছু পানির ড্রেনের ভিতরে যাবে, ড্রেন বন্ধ করে পয়নিষ্কানে বিপর্যয় ঘটবে। বৃষ্টির পানি নিষ্কাষিত হতে না পেরে ঢাকা শহরের জলবদ্ধতাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে, বেশির ভাগরই শেষ ঠিকানা বুড়িগঙ্গায়, তারপর মেঘনা হয়ে বঙ্গোবসাগরে।
নদী সাগর এর তলদেশ ভরাট হওয়াকে আরও ত্বরান্বিত করবে। এগুলো যুগ যুগ ধরে ধ্বংস হতে থাকবে। মাছে খাবে, পানিতে মিশবে, মাছ ও লবণের মাধ্যমে আবার আমাদের দেহে ফিরে আসবে, আমাদের দেহে নানাবিধ জটিল রোগ ছড়াবে। উল্লেখ্য গত ০৬/০১/২০২০ তারিখে মাননীয় হাইকোর্ট আগামী ০৫/০১/২০২১ তারিখের মধ্যে দেশের সকল হোটেল, রেস্তোরা ও উপকূলীয় অঞ্চলে একবার ব্যবহৃত প্লাষ্টিক পণ্য (One time use Plastic materials) এর ব্যবহার বন্ধ করণের জন্য সরকারের প্রতি এক যুগান্তকারী আদেশ জারি করেছে।

এ তো গেল কাগজ, কালি আর পলিথিন দূষণের বিষয়। তারপর আছে শব্দ দূষণ, তার মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ দূষণে পরিবেশ দূষণের বিষয়টি না হয় বাদই দিলাম, কিন্তু নির্বাচনের পরপরই শুরু হবে এসএসসি পরীক্ষা, তাদের কথা তো আর বাদ দেয়া যায় না। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা এটি।
এভাবে শব্দ দূষণ চললে পরীক্ষার্থীদের কি অবস্থা দাড়াচ্ছে-তা কি নির্বাচনী প্রার্থীগন এবং তাঁদের অনুসারীগন একবার ভেবে দেখেছে? যদি কোন রাজনৈতিক দলের কোন প্রার্থীর শব্দ দূষণের কারনে কোন পরীক্ষার্থীর লেখা পড়ার বিঘ্ন ঘটে, তবে তার পরিবারের ভোট বিরোধী শিবিরের প্রার্থীর অনুকূলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক এবং ঐ পরীক্ষার্থী কখনও তার পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য ক্ষতিকারক রাজনৈতিক দলের পক্ষে থাকবে না এটাও স্বাভাবিক। তাই রাজনৈতিক দলসমুহকে তাদের সুনাম ও সমর্থণ দীর্ঘ মেয়াদে অনুকূলে রাখার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন রয়েছে বৈকি।
এমনিতেই চলতি শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা পুরো বিশ্বের নগরগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগ সময়েই পরিবেশ দূষণে ১ম স্থান দখল করে আসছে, যে সকল দিন ১ম স্থানে থাকে না সে সকল দিন ২য়, ৩য়, ৪র্থ বা কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। ঢাকার এ দূষণের কারণ – অনেকেই অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করলেও মূল কারণ গুলো কেউই ক্ষতিয়ে দেখেননি। নির্বাচনের সময় তা এখন আর বলতে চাই না।
তবে এ দূষণ একদিনে হয়নি, যুগ যুগ ধরে চলে আসা আমাদের ব্যক্তিগত বদ অভ্যাসও এর জন্য কম দায়ী নয়। সরকার গত এক বছর হতে উঠে পড়ে লেগেছে ঢাকাসহ সারাদেশের পরিবেশ উন্নয়ন ঘটাতে, তার মধ্যে রয়েছে ঢাকাসহ সমস্ত দেশের অবৈধভাবে ও অবৈধ পদ্ধতিতে গড়ে উঠা ইট ভাটা ধ্বংস করা, নদী ও সড়কের পাশের অবৈধ স্থাপনা ধ্বংস করা, প্রতিদিনের দু’বার করে ঢাকার রাস্তায় পানি ছিটানো ইত্যাদি। এতে করে সাময়িক ভাবে কিছুটা কাজও হচ্ছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী এ দূষণ হতে মুক্তি পেতে আমলাতান্ত্রিক পথে না হেটে সরকারকে বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে এগোতে হবে।
যদি এ সময় সিটি কর্পোরেশণ নির্বাচন না দিয়ে ২(দু) মাস পরে অর্থাৎ মার্চ-এপ্রিলে কিছু কিছু বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় দিলে আমরা নির্বাচণ কমিশনকে পরিবেশ সচেতন বলতে পারতাম। যাক রাজনৈতিক বিষয় হতে আমরা দূরে থাকতে চাই, আমাদের কাজ পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়ে এ গ্রহবাসীকে সচেতন করা, পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে জাগিয়ে তোলা।
পরিবেশ বিপর্যয়ের এ অসময় মূহুর্তে নির্বাচণ কমিশন যখন নির্বাচণ দিয়েই দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে একবার পিছানোও হয়েছে, সামগ্রিক দিক বিবেচনায় এখন আর পিছানো ঠিকও হবে না, তবে গড়পড়তা পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে নির্বাচণ কমিশন নিন্মোক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে বলে মনে করা যেতে পারে:
১. ওয়ার্ডের আয়তনের ভিত্তিতে প্রার্থীদের পোষ্টার লাগানোর সংখ্যা নির্ধারণ করে দেওয়া।
২. বড় রাস্তা ও অলিগলিতে দূরুত্বের ভিত্তিতে পোষ্টার লাগানোর সংখ্যা নির্ধারন করে দেওয়া।
৩. প্রার্থীদেরই পোষ্টার সড়কের যত্রতত্র পড়ে থাকা রোধে এবং কোন কারনে পড়ে গেলে তা সে প্রার্থীকেই পূনঃস্থাপন বা রাস্তা হতে জরুরী সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা নেয়া এবং নির্বাচণের ফল ঘোষনার পরপরই বিজয়ী ও বিজিত সকল প্রার্থীগনকেই রাস্তা/দেওয়াল হতে নির্বাচনী পোষ্টার, ব্যানার, লিফলেট নিজেরাই সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা।
৪. ইতোমধ্যে নির্বাচনী এলাকার প্রদর্শিত সকল লেমিনিটিং পোষ্টার সরিয়ে ফেলা এবং আর কোন লেমিনিটিং পোষ্টার প্রদর্শণ না করার ব্যবস্থা করা।
৫. সন্ধ্যার পর পরই প্রার্থীদের মিছিল বা মাইকিং বা নির্বাচনী গান/রেকর্ড বাজানো বন্ধ করার ব্যবস্থা করা।
৬. ভোট কেন্দ্রসমূহে নির্বাচণী লিফলেট বিতরণ নিয়ন্ত্রন করা এবং পার্থীগণের পক্ষ হতে যত্রতত্র পড়ে থাকা পোষ্টার/লিফলেট নিজেদের উদ্যোগে পরিস্কারের ব্যবস্থা করা যাতে এগুলো পঁচে গিয়ে ছাত্রছাত্রীগণ সীসা দ্বারা আক্রান্ত না হয়, কারণ অধিকাংশ ভোট কেন্দ্রই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং ভোটের পর কেহ আর তার খোজ রাখে না।।
৭. ১-৬ পর্যন্ত ক্রমিকে বর্ণিত বিষয়গুলো সঠিকভাবে মনিটরিং করা ও ভবিষ্যতে এ প্রস্তাবগুলোসহ পরিবেশ বিশেষজ্ঞ প্যানেলের মতামত নিয়ে তা নির্বাচণী আইনের অর্ন্তভূক্তির ব্যবস্থা নেয়া।