পরিবেশের ওপর পোশাকের প্রভাব
২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে টেকসই ফ্যাশন সম্মেলনের আয়োজন করে ড্যানিশ ফ্যাশন ইনস্টিটিউট। যেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন ফ্যাশন খাতসংশ্লিষ্ট সাড়ে ৬০০ পেশাদার, বিশেষজ্ঞ ও এনজিও প্রতিনিধি।
এ আয়োজনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল একই মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কপ-১৫ সম্মেলনে টেকসই ফ্যাশন বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখা। ওই সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যার একটি বড় অংশের কাছেই পরিবেশবান্ধব, ভিগান, অর্গানিক বা সাসটেইনিবিলিটির মতো শব্দ সম্পর্কে যথার্থ ধারণা ছিল না।
পরের বছরগুলোতে জলবায়ুনিরপেক্ষ উপাদানের উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করতে এবং এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার প্রতিশ্রুতিতে টেকসই ফ্যাশনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন ফ্যাশন খাতসংশ্লিষ্টরা।
কার্বন নিঃসরণের বিষয়টি যে জলবায়ু পরিবর্তনের মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ– এ উপলব্ধির পর বিশ্বজুড়ে টেকসই ফ্যাশন ধারণাটি আলোচিত হতে শুরু করে।
বর্তমান সময়ে আমরা সবাই পরিবেশের ওপর পোশাকের প্রভাব নিয়ে কমবেশি সচেতন হয়ে উঠেছি। ফলে ‘টেকসই ফ্যাশন’ অভিধা হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কিন্তু টেকসই ফ্যাশন বলতে আসলে কী বোঝায়? একুশ শতকে কেনইবা এ ধারণা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল?
টেকসই ফ্যাশন বলতে পরিবেশের ঝুঁকিসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পোশাকের উৎপাদন। পোশাকের ক্ষেত্রে টেকসই বললে কাঁচামাল থেকে শুরু করে পোশাক প্রক্রিয়াজাত করা, পোশাকের ব্যবহার, যত্ন নেওয়া এবং পোশাকটির ব্যবহার শেষ হওয়া পর্যন্ত পরিবেশের ওপর এর প্রভাব বোঝায়।
পোশাক উৎপাদনে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার করতে হয় এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ৮-১০ শতাংশ বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের জন্য পোশাক খাত দায়ী, যা বিমান ও জাহাজ চলাচলে নির্গত গ্যাসের চেয়েও বেশি।
বিশ্বব্যাংক মনে করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিকভাবে পোশাকের বিক্রি ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। ফলে এটি সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে, ক্রমবর্ধমান এ উৎপাদন পরিবেশ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে আরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
কাঁচামাল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করতে গিয়ে পরিবেশের অনেক ধরনের ক্ষতির কারণ হচ্ছে পোশাক খাত। পোশাকের বেশিরভাগ কাঁচামাল এমনভাবে সংগ্রহ করা হচ্ছে, যা শেষতক এই বিশ্বকেই অস্বাস্থ্যকর করে তুলছে।
পলিয়েস্টারের জন্য পেট্রোলিয়াম পরিশোধন থেকে শুরু করে পানিদূষণ, মাটিদূষণ ও ক্ষয় এবং তুলা উৎপাদন করতে গিয়ে বন ধ্বংস করা– এর সবই পরিবেশের ক্ষতির উদাহরণ।
এভাবে পোশাক খাত কেবল বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণই করছে না, পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যকেও ক্রমশ ক্ষতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, যা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশগত ঝুঁকি হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
এই খাতকে পরিপূর্ণভাবে টেকসই করে তোলার ক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হতে হবে কাঁচামালের রূপান্তর। বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত ফেব্রিকের প্রায় ৬০ শতাংশই নাইলন বা পলিয়েস্টারের মতো সিনথেটিক উপাদানে তৈরি, আদতে যা প্লাস্টিকেরই একটি ধরন এবং মাটি ও পানিতে অপচনশীল।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এসব ফাইবার পানিতে ধোয়ার সময় মাইক্রোফাইবার নিঃসরণ করে, যা সমুদ্র দূষণ করছে, সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করছে এবং সামুদ্রিক খাবারের মাধ্যমে আমাদের শরীরে এসে ক্ষতির কারণ হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে তুলার পরিবর্তে পলিয়েস্টার স্টেপল, ভিসকোস ও ভিসকোস স্টেপলের মতো অপ্রাকৃতিক ফাইবারের চাহিদা ক্রমে বাড়ছে, যা বৈশ্বিক ফ্যাশন ট্রেন্ডে সমূহ পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৭৮ হাজার ২০৮ টন পলিয়েস্টার স্টেপল আমদানি করা হয়েছে, যা ২০১৫ সালে আমদানি করা ৭০ হাজার ২০৯ টন থেকে ১১ দশমিক ৩৯ শতাংশ বেশি এবং ২০১৪ সালে আমদানি করা ৫১ হাজার ৭২৯ টন থেকে ৩৫ দশমিক ৭২ শতাংশ বেশি।
প্রাকৃতিক ফাইবার বাছাই করা নিঃসন্দেহে একটি সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু এর মানে এই নয়, ফাইবার প্রাকৃতিক হওয়ার ফলে এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেকসই হয়ে যাবে। এই প্রাকৃতিক ফাইবারের উৎস কোথায়, তাও আমাদের বিবেচনা করতে হবে।
ভিসকোস বা ভিসকোস রেয়ন এ রকমই একটি টেকসই ফেব্রিকের উদাহরণ, যার জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়ছে। পোশাক, হোম ডেকোর থেকে শুরু করে সবকিছুতেই এখন এই উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক অবস্থা বিবেচনায় অনুমেয়, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে প্রতি বছর ফেলে দেওয়া বর্জ্য-পোশাকের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩৪ মিলিয়ন টন। পোশাক থেকে উৎপাদিত এই বর্জ্যের বেশিরভাগই আবার নাইলন, পলিয়েস্টার ও অ্যাক্রিলিকের মতো অপচনশীল ফাইবার, যা আসলে প্লাস্টিকেরই নানা ধরন এবং কয়েক শতাব্দী ধরে প্রকৃতিতে রয়ে গিয়ে দূষণের কারণ হবে।
ফলে ক্রেতাদের কাছে এখন টেকসই উপায়ের চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। পাশাপাশি ব্র্যান্ডগুলোও সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এদিকে ঝুঁকছে। আমাদের আবাসস্থল এই গ্রহকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এবং আরও দায়িত্বশীলভাবে জীবন ধারণ করতে বিকল্প টেকসই উপায়গুলো ব্যবহার করা শুরু করতে হবে। উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে টেকসই উন্নয়নকে আমাদের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে।