পরিবেশ রক্ষায় দেশেই তৈরি হবে পরিবেশবান্ধব ইট
ইট তৈরির জন্য আর মাটি পোড়াতে হবে না। নদীর ভরাট বালু, পলি, সিমেন্ট ও একধরনের রাসায়নিক পদার্থ মিশিয়ে তৈরি করা হবে ইট। মাটির তৈরি ইটের মতোই এই ইট টুকরা টুকরা করে ভেঙে ঢালাইয়ের জন্য খোয়া হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
মাটির ইটের চেয়ে বেশি টেকসই এই ইট তৈরির খরচও কম পড়বে। থাকবে না দেয়ালে নোনা ধরার ভয়। এই ইট দিয়ে তৈরি করা ঘর মাটির ইটের চেয়ে গরমও কম হবে। এমনই দাবি জাপানি প্রকৌশলীদের।
বুধবার জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জাইকার প্রকৌশলীরা রাজশাহীতে এক কর্মশালায় এমনটিই দাবি করেছেন। কর্মশালায় তাঁরা তাৎক্ষণিকভাবে এই ইট তৈরি করে দেখিয়েছেন। প্রকৌশলীদের দাবি, জাপানি প্রযুক্তিতে তৈরি পরিবেশবান্ধব ইট আর বাংলাদেশে তৈরি সিমেন্টের ইট এক নয়।
রাজশাহী নগরের নামোভদ্রা এলাকার আকাফুজি নার্সারিতে এই কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে জাইকা প্রকল্পের তিনজন প্রকৌশলী উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা হলেন ইচিহাসি ইউইচি, কুবোতা ইউকিও ও কাতো কিওকি।
এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির প্রকল্প সমন্বয়কারী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের সাবেক অধ্যাপক উদ্ভিদবিজ্ঞানী এম মনজুর হোসেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা ও পরিবেশবাদীরা উপস্থিত ছিলেন।
কর্মশালায় বলা হয়, জাপানি প্রযুক্তিতে তৈরি ইট আগুনে পোড়ানোর দরকার হবে না। তৈরি ইট ১৫ দিন পর আপনা-আপনি জমে যাবে। তখন থেকেই ব্যবহার করা যাবে।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) এই ইটের বর্ণিত গুণাগুণ পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষায় কাঙ্ক্ষিত গুণাগুণ পাওয়া গেলে জাইকা বাংলাদেশে এই ইট তৈরির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে।
কর্মশালায় ইচিহাসি ইউইচি মাটি না পুড়িয়ে কীভাবে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরি করা যায়, তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে ইট তৈরির প্রধান উপাদান মাটি। তাঁদের উদ্ভাবিত পরিবেশবান্ধব ইটে কোনো মাটি ব্যবহার করা হবে না।
এই ইট তৈরির জন্য নদীতে জমা হওয়া ভরাট বালু ও নদীর একটু এঁটেল পলিমাটি এবং সিমেন্ট এই ইটের প্রধান উপাদান। সঙ্গে শুধু একটি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে।
ইচিহাসি ইউইচির বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে প্রকল্প সমন্বয়কারী এম মনজুর হোসেন বলেন, প্রতিবছর বাংলাদেশে ২৫ হাজার কোটি ইট তৈরি হয়। এই পরিমাণ ইট তৈরিতে দেশের কৃষিজমির উপরিভাগের যে পরিমাণ মাটি ব্যবহার করা হয়, তা উদ্বেগজনক।
কারণ, উপরিভাগের মাটিতেই ফসল হয়। ওপরের ১২ ইঞ্চি পরিমাণ মাটিতেই ফসল চাষের উর্বরতা থাকে। একবার কোনো কৃষিজমি থেকে উপরিভাগের মাটি কেটে নিলে প্রাকৃতিকভাবে তা তৈরি হতে প্রায় ১০০ বছর সময় লাগে।
মনজুর হোসেন বলেন, ‘আমাদের পদ্মা ও যমুনা নদীতে প্রতিবছর চার হাজার কোটি টন ভরাট বালু ভারত থেকে এসে জমা হয়। তাই পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির জন্য কাঁচামালের কোনো অভাব হবে না।
পরিবেশবান্ধব ইট তৈরির জন্য এই ভরাট বালুর সঙ্গে খুব সামান্য পরিমাণে নদীর এঁটেল পলিমাটি ব্যবহার করা হবে। ১০০ কেজি ভরাট বালুর সঙ্গে মাত্র ২ কেজি এঁটেল পলিমাটি ব্যবহার করা হবে।’
মনজুর হোসেন জানান, এঁটেল মাটি বালুর তৈরি ইটের চারপাশে আবরণ হিসেবে থাকবে। এ কারণে ইট কম গরম হবে। এতে যে রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হবে, তা একজন জাপানি গবেষকের ৪০ বছরের গবেষণার ফসল।
গবেষণা করে দেখা হয়েছে, এই রাসায়নিক পদার্থ কোনোভাবেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নয়। সাধারণত মাটির তৈরি ইট দিয়ে ঘর তৈরির পর দেখা যায়, দেয়ালে নোনা ধরে, পরিবেশবান্ধব ইটের দেয়ালে নোনা ধরবে না।
এমনকি যেসব অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা রয়েছে, সেই অঞ্চলের ভরাট বালু দিয়েও এই ইট তৈরি করা যাবে। ইট তৈরির সময় মাটির এই লবণ স্বয়ংক্রিয় উপায়ে বের করে হয়ে যাবে।
রাজশাহীতে পরীক্ষামূলকভাবে এই ইট তৈরির জন্য মোংলা, রংপুর, রাজশাহী ও রাজশাহীর গোদাগাড়ীর এলাকার বালুর নমুনা নিয়ে আসা হয়েছে। কর্মশালার পরই হস্তচালিত একটি যন্ত্রের মাধ্যমে ইট তৈরি শুরু করা হয়েছে।
১৫ দিন পরই এই ইট ব্যবহার করা যাবে। তখন রুয়েটে এই ইটের গুণাগুণ পরীক্ষা করা হবে। পরীক্ষায় সব গুণাগুণ মিলে গেলে জাইকা বাংলাদেশে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।
জাইকার প্রকৌশলীরা আশা প্রকাশ করেন, এই ইট তৈরির মাধ্যমে বাংলাদেশে উচ্চমানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন ঘটবে, বায়ুদূষণ ও বৈশ্বিক উষ্ণতা হ্রাস পাবে, কৃষিকাজ ও গ্রামীণ জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।