পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি দুর্বল হচ্ছে- তবে কি কেয়ামত আসন্ন?

ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি (ESA)এর স্যাট্রেলাইট অ্যারে সোর্য়াম নামে একটি উপগ্রহ কর্তৃক সংগ্রহ করা তথ্য অনুসারে, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র গত ছয় মাস ধরে দুর্বল হয়ে পড়েছে। উল্লেখ্য যে, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র গ্রহকে মারাত্মক ক্ষতিকর সৌর বিকিরণের প্রভাব হতে রক্ষা করে।
সোর্য়াম স্যাটেলাইটটিতে স্থাপনকৃত একটির পর একটি করে মোট তিনটি চৌম্বকীয় শক্তি পরিমাপক এর সাহায্যে গৃহীত তথ্যাদি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের বৃহত্তম দুর্বল অংশটির ক্রমশই বিস্তৃতি ঘটছে এবং বর্তমানে ভূ-পৃষ্ঠের উপরে উহার দৈর্ঘ্য ৩৭০,০০০ মাইল (৬০০০,০০০ কিলোমিটার)এ দাড়িয়েছে। চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি যখন দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের মতো অঞ্চলগুলিতে শক্তিশালী হয়েছে, তখন পশ্চিম গোলার্ধের আটলান্টিক এবং আমেরিকার উপরে দুর্বলতা ছড়িয়ে পড়েছে।
ইএসএ (ESA) সোর্য়াম মিশনের ব্যবস্থাপক রুন ফ্লোবার্গেজেন বলেছেন, গবেষকরা যারা গবেষণাটি চালিয়েছে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি কেন দুর্বল হচ্ছে – এ বিষয়ে তারা অনিশ্চিত, তবে একটি সম্ভাব্য কারণ হ’ল পৃথিবীর চৌম্বকীয় মেরুগুলো (poles) উল্টাতে প্রস্তুত হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, সংগৃহীত উপাত্তসমূহ হতে দেখা যায় যে, চৌম্বকীয় উত্তর মেরুটি সাইবেরিয়ার দিকে সরে যাচ্ছে।
ফ্লোবার্গেজেন লাইভ সায়েন্সকে জানিয়েছে “এই ধরনের উল্টানো তাৎক্ষণিকভাবে নয়, তবে কয়েক হাজার বছর না হলেও বহুশত বছর লাগবে। উল্লেখ্য যে, চৌম্বুকীয় মেরু পৃথিবীর সৃষ্টির পর অতীতে অনেকবার উলট পালট হয়েছে।” [50 Amazing Facts About Planet Earth]
বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যে জানেন যে, পৃথিবীর চৌম্বকীয় উত্তর মেরু স্থানান্তরিত হয়। প্রতি কয়েক লক্ষ বছরে একবার চৌম্বকীয় মেরু দু’টি উল্টে যায়- যাতে একটি কম্পাস উত্তরের পরিবর্তে দক্ষিণে নির্দেশ করে। ভূ- পৃষ্ঠের স্থানে স্থানে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের শক্তি বৃদ্ধি পাওয়া বা হ্রাস পাওয়ার পরিবর্তনসমূহ উল্টানো চক্রেরই অংশ। তবে সোর্য়ামের তথ্য হতে দেখা যায় যে ক্ষেত্রটি অতীতের চেয়ে দ্রুত দুর্বল হতে শুরু করেছে। পূর্বে গবেষকরা অনুমান করেছিলেন যে, ক্ষেত্রটি প্রতি শতাব্দীতে প্রায় ৫ শতাংশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তবে নতুন তথ্য থেকে জানা গেছে যে, ক্ষেত্রটি বাস্তবে প্রতি দশকে ৫ শতাংশ বা অনুমানের চেয়ে ১০ গুণ বেশি দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েছে। যেমনটি, পূর্বাভাস অনুসারে প্রায় ২,০০০ বছরের মধ্যে পুরো উলটপালট ঘটানোর পরিবর্তে, নতুন তথ্য বলেছে যে এটি আরও শীঘ্রই ঘটতে পারে।
ফ্লোবার্গেজেন আশা করেছেন যে, সোর্য়াম কর্তৃক আরও উপাত্ত সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করে দেখা হবে যে, কেন ক্ষেত্রটি এখন দ্রুত দুর্বল হচ্ছে।
অনেকের ধারণা পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের দূর্বল হয়ে যাওয়া বা চৌম্বুকীয় মেরুরর উলট পালট হয়ে যাওয়া কেয়ামতের লক্ষণ। কিন্তু বিজ্ঞাণীরা বলেছে, কোনও দুর্বল চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের পরিণতি পৃথিবীর জন্য কিয়ামত দিবস হওয়ার প্রমাণ নেই। অতীতের মেরুতা উলটপালট হওয়ার সময় কোনও বৃহদায়তন বিলুপ্তি বা বিকিরণের ক্ষতির প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গবেষকরা মনে করেন যে, ঐ সময়ে পাওয়ার গ্রিড এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি একটি বিশাল অদৃশ্য বুদবুদের মতো কাজ করে যা গ্রহকে সৌর প্রবাহ (solar winds) আকারে সূর্য থেকে বিপজ্জনক মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে রক্ষা করে।পৃথিবীর একটি বিশাল চৌম্বকীয় ক্ষেত্র বিদ্যমান আছে, কারণ পৃথিবী গলিত ধাতবের একটি বাহ্যিক স্তর দ্বারা বেষ্টিত তার কেন্দ্রে রয়েছে লোহার একটি বিশাল বল। পৃথিবীর কোরের তাপমাত্রার পরিবর্তণ এবং আবর্তনের ফলে কোরের তরল ধাতু ফুটিয়ে গলিত করে তোলে এবং তরল ধাতু কোরের চারিদিকে বাহিরে একটি চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের লাইন তৈরি করে।
ফ্লোরবার্গেজেন বলেন যে, গলিত ধাতুর গতিবিধি কেন চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কিছু অঞ্চলকে শক্তিশালী করে এবং অন্য অংশকে দুর্বল করে? কারণ, বাইরের কোরের একটি অঞ্চলে ফুটন্ত তরল ধাতুর নির্গমণ যখন ধীর হয়ে যায় তখন চার্জযুক্ত কণার কম স্রোত হয়, তখন ঐ সমস্ত স্থানে ভূ-পৃষ্ঠের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটি দুর্বল হয়ে যায়।
ফ্লোবার্গেজেন বলেছেন,”তরল বহিরাগত কোর এর প্রবাহ প্রায় চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটিকে এটির সাথে প্রায় টান দেয়। সুতরাং আমেরিকান মহাদেশের ক্ষেত্র দুর্বল হওয়ার অর্থ আমেরিকার নীচের বাইরের অংশের প্রবাহ হ্রাস পাচ্ছে।”
সোর্য়াম সেটেলাইট কেবল পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র থেকে আগত সংকেত গ্রহণ করে না, এটি পৃথিবীর কোর, আচ্ছাদন, ভূত্বক এবং মহাসাগর থেকেও আসা সংকেত গ্রহণ করে। ইএসএ’র বিজ্ঞানীরা এই উপাত্তসমূহ ব্যবহার করে নেভিগেশন সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম যা চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করবে। এই নেভিগেশন সিস্টেম ব্যবহার করে আরও নির্ভুলভাবে বিমানের যন্ত্রাংশ স্থাপন করতে পারবে, ভূমিকম্পের পূর্বাভাস উন্নত করতে পারবে এবং ভূ-পৃষ্ঠের নীচে প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ স্থানসমূহ সহজে নির্ণয় করতে পারবে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ওঠানামা কোথায় মহাদেশীয় প্লেটগুলি স্থানান্তর করছে যা দ্বারা ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করতে পারে।
১৯ শে জুন ২০২০ তারিখে ডেনমার্কের তৃতীয় সোর্য়াম বিজ্ঞান সভায় সোর্য়ামের এর প্রাপ্ত ফলাফলসমূহ এই প্রথম উপস্থাপন করা হয়েছিল।
Source: Live science, Research and innovation, and Business Insider