বায়ুদূষণ: আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই — অধ্যাপক আইনুন নিশাত
বায়ুদূষণ মোকাবিলায় আমাদের জ্ঞান, নীতিমালা ও আইন থাকলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবই প্রধান সমস্যা—এমন মন্তব্য করেছেন খ্যাতিমান জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত।
‘নীরব ঘাতক বায়ুদূষণ: সমস্যার গভীরতা ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি বলেন, আলোচনার সময় শেষ—এখন কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার সময়।
জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে শনিবার অনুষ্ঠিত এই সেমিনারটি যৌথভাবে আয়োজন করে ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট এবং ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, “জল, বায়ু, নদীসহ পরিবেশ নিয়ে প্রচুর গবেষণা ও আইন রয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে প্রয়োগের অভাবে। এই অবস্থার পরিবর্তন আনতে হলে জনমত গড়ে তুলে আইন বাস্তবায়নের জোর দাবি তুলতে হবে।”
সেমিনারে দুটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়—একটি রাজধানীসহ দেশের বায়ুদূষণের কারণ ও প্রতিকারের উপায় নিয়ে এবং অপরটি বায়ুদূষণের স্বাস্থ্যগত প্রভাব নিয়ে।
প্রকৌশলী সরদার আমিন জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি শহরের ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স’ (AQI) ৫০ হলে তা নিরাপদ ধরা হয়; ১০০ ছাড়ালেই তা বিপজ্জনক। ২০২৪ সালে ঢাকায় AQI ছিল ১২৪, যা ৩৫ দিন স্থায়ী ছিল—বিশ্বের আর কোনো শহরে এত দীর্ঘমেয়াদি দূষণের নজির নেই। দিল্লির সর্বোচ্চ AQI ছিল ২০৯, কিন্তু মাত্র ১০ দিন; লাহোরে ছিল ১২৬, সেটিও ১০ দিন। স্থায়িত্বের দিক থেকে ঢাকাই শীর্ষে।
তিনি আরও জানান, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৮৭ হাজার মানুষের বসবাস—যেখানে আদর্শ সংখ্যা হওয়া উচিত ৬,৫০০। এই অতিরিক্ত জনসংখ্যা, রান্নাঘরের ধোঁয়া, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, ইটভাটা, কলকারখানা এবং নির্মাণসামগ্রীর ধুলা—সব মিলিয়ে বায়ুদূষণের বড় কারণ। তিনি দূষণ রোধে ১৫টি সুপারিশ তুলে ধরেন।
চিকিৎসক তামান্না বাহার বলেন, বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে। বাংলাদেশে PM2.5 মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৭৮ মাইক্রোগ্রাম—যা WHO নির্ধারিত সীমার ১৫ গুণ। এসব অতিক্ষুদ্র কণায় থাকা ক্ষতিকর উপাদান থেকে কাশি, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, হৃদরোগ, ক্যানসার, স্নায়ু সমস্যা এবং গর্ভবতীদের জটিলতা সৃষ্টি হয়। ২০২১ সালে এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে ২ লাখ ৩৫ হাজার মৃত্যুর পেছনে বায়ুদূষণ দায়ী।
তিনি বলেন, এত মৃত্যুর পাশাপাশি চিকিৎসা খরচের বোঝা পরিবার ও দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ২০১৬ সাল থেকে ঢাকার বায়ুদূষণ ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। শুধু কোভিডকালে কিছুটা কমেছিল। তিনি পরামর্শ দেন, দিনে বেলা তিনটা থেকে পাঁচটার মধ্যে তুলনামূলকভাবে দূষণ কম থাকে এবং প্রতিনিয়ত মাস্ক ব্যবহারে উপকার হবে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ শেখ মো. মেহেদী হাসান বলেন, এই শহর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে। “আইন আছে, কিন্তু প্রভাবশালীদের জন্য কোনো আইন কার্যকর হয় না। তারা জলাধার ভরাট, নদী দখলসহ দূষণে ভূমিকা রাখছে—এই সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে।”
প্রকৌশলী আল্লামা আর রাজি বলেন, “উন্নয়নের সঙ্গে দূষণ জড়িত, তবে সঠিক ব্যবস্থাপনা থাকলে তা কমানো সম্ভব।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণ শুধু মানুষ নয়, সমগ্র জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তিনি উচ্চ আদালতের ১২ দফা নির্দেশনাসহ পরিবেশ আইনের কঠোর প্রয়োগের আহ্বান জানান।
সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন ডক্টরস ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলাম। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রকৌশলী নিমাই গাঙ্গুলি, এবং সঞ্চালনা করেন চিকিৎসক আনোয়ারুল আনাম কিবরিয়া।
🌱 গ্রিন পেইজ – পরিচ্ছন্ন বাতাস ও সবুজ ভবিষ্যতের জন্য আপনার নির্ভরযোগ্য কণ্ঠস্বর 🌍