সুন্দরবনে পর্যটনের চাপে হুমকিতে পরিবেশ
বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবনের বিভিন্ন খাত থেকে প্রতিবছর সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে পর্যটকদের যাতায়াত। এরই মধ্যে পর্যটকদের আকর্ষণ করতে বনে তৈরি করা হচ্ছে নতুন নতুন পর্যটনকেন্দ্র। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর চাপ বাড়ছে।
সুন্দরবনের আয়তন প্রায় ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার। বন বিভাগের তথ্য বলছে, সমগ্র সুন্দরবনের প্রায় ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশে অবস্থিত, যার ৬৯ শতাংশ স্থলভাগ ও ৩১ শতাংশ জলভাগ। বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবন পশ্চিম ও পূর্ব দুই অংশে বিভক্ত।
বন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় সুন্দরবন থেকে বিভিন্ন ধরনের কাঠ, মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধুসহ ১২ ধরনের খাত থেকে রাজস্ব আহরণ করা হতো। ১৯৮৯ সালে আইন করে গেওয়া, গরান ছাড়া সব ধরনের গাছ কাটা বন্ধ করা হয়। ২০০৭ সালে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় সিডর ও ২০০৯ সালে আইলার পর গেওয়া ও গরান আহরণও বন্ধ করে দেয় বন বিভাগ। বর্তমানে শুধু মাছ, কাঁকড়া, গোলপাতা, মধু ও পর্যটন থেকে রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগ থেকে রাজস্ব আহরণ করা হয়েছে ৪ কোটি ৩ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৪৪ লাখ ৭৬ হাজার টাকায়। অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পূর্ব বন বিভাগ বিভিন্ন উৎস থেকে রাজস্ব আদায় করেছে ৫ কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায় করেছে ৬ কোটি ৯৩ লাখ ২৩ হাজার টাকা। রাজস্ব আদায় বাড়াতে গিয়ে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সম্পদ উজাড় করে ফেলা হচ্ছে বলে অভিযোগ পরিবেশকর্মীদের।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, সরকার চায় রাজস্ব বৃদ্ধি পাক। সেই হিসেবে বৃহৎ এই সুন্দরবনের গুটিকয়েক কয়েক খাত থেকে রাজস্ব আদায় করা হচ্ছে। তবে পুরো সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকা রয়েছে সংরক্ষিত। ওই এলাকাগুলো রয়েছে রাজস্ব আহরণের বাইরে। এ কারণে রাজস্ব আহরণ করতে গিয়ে বনের খুব বেশি ক্ষতি হচ্ছে না।
সুন্দরবনের ভেতরে বর্তমানে আটটি পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে বছরে প্রায় দুই লাখ পর্যটক ভ্রমণ করেন। ওই পর্যটনকেন্দ্রগুলো হলো পূর্ব বন বিভাগের আওতাধীন করমজল, হারবাড়িয়া, কটকা, কচিখালী ও দুবলার চর। আর পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন হিরণ পয়েন্ট (নীল কমল), কলাগাছী ও কাগা দোবেকী। এসব স্থানে ভ্রমণ করা পর্যটকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
বন বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে পশ্চিম বন বিভাগ থেকে অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে ভ্রমণে গেছেন ৫৯ হাজার ৯১৫ জন। এ থেকে রাজস্ব এসেছে ৪৯ লাখ ৯৪ হাজার ৩০০ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ভ্রমণ করেছেন ৭৩ হাজার ৬১৩ জন। রাজস্ব উঠেছে ৭৬ লাখ ১৯ হাজার ৪৭০ টাকা।
অন্যদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরে পূর্ব বন বিভাগ পর্যটন থেকে রাজস্ব পেয়েছে ৬৭ লাখ ৬ হাজার ৫৭৬ টাকা। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব পেয়েছে ৮৮ লাখ ৯৪ হাজার টাকা।
এই পর্যটনকেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি নতুন করে তিনটি ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র তৈরি করছে বন বিভাগ। এগুলো হচ্ছে সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের শেখেরটেক ও কালাবগী এলাকায় এবং শরণখোলা রেঞ্জের আলীবান্ধা ও চাঁদপাই রেঞ্জের আন্ধারমানিকে। এসব পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণে আশপাশের বিপুল পরিমাণ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা পড়েছে। বনের মধ্যে তৈরি করা হচ্ছে কংক্রিটের স্থাপনা। এতে ওই এলাকার জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে।
সম্প্রতি খুলনা রেঞ্জের নির্মাণাধীন কালাবগী ও শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, পর্যটকদের জন্য কেন্দ্র দুটিকে বনের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে কংক্রিটের ওয়াকওয়ে ও ওয়াচ টাওয়ার। আছে টিকিট কাউন্টার, বাথরুম ও বিশ্রামের জায়গা। এসব কাজ করতে কাটা হয়েছে বিপুল পরিমাণ গাছ।
জানতে চাইলে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, তাঁরা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পর্যটকদের আনাগোনা কমিয়ে আনতে চান। প্রতিবছর যে পরিমাণ পর্যটক ওইসব এলাকায় ভ্রমণ করেন, তা বনের জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকিস্বরূপ।
কিন্তু পর্যটক তো আর কমিয়ে আনা সম্ভব নয়। এ কারণে বনের শুরুর এলাকাগুলোতে পর্যটনকেন্দ্র করা হয়েছে। এতে বনের ভেতরের অংশে মানুষের চাপ কমবে। এ ছাড়া যে অংশটুকু নিয়ে পর্যটনকেন্দ্র করা হয়েছে, সেটি বনের বিবেচনায় খুবই ক্ষুদ্র অংশ।