মানুষের খাদ্য হিসাবে কচুরিপানার উপযোগীতা এবং মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশনার ব্যঙ্গাত্মক সংবাদ পরিবেশনা
কচুরিপানা (Water Hyacinth) একটি জলজ উদ্ভিদ। ইহা জলের উপরে ভাসমান দ্রুত বর্ধণশীল উদ্ভিদ। ইহার বৈজ্ঞানিক নাম Eichhornia crassipes । সারা বিশ্বেই এটি দেখা যায় এবং ইহা জলীয় উপদ্রব হিসাবে পারচিত।

পূর্ব এশিয়ার তাইওয়ানে ক্যারোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য হিসাবে সবুজ অংশ শাক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাপানিজরা সবুজ কঁচি ডাল ও ফুল রান্নার সবজি হিসাবে ব্যবহার করছে এবং ভিয়েতনামীরাও তরুণ পাতা ও ফুল সালাদ হিসাবে খাচ্ছে ( Wikipedia)।
কচুরিপানার সবুজ অংশ প্রোটিন সমৃদ্ধ হওয়ায় মানুষের খাদ্য হিসাবে গ্রহনের বিষয়ে যুগেযুগে বহু গবেষনা হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তেমন ভাবে অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
গবেষনার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য গবেষণাটি “The Egyptian Journal of Aquatic research (Volume 42, Issue & September 2016, Pages 269-272) এ প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষনায় কচুরিপানা মানুষের খাদ্য হিসাবে নিরাপদ ও সম্ভাবনাময় হিসাবে ফলাফল প্রাপ্ত হয়েছে। উক্ত গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফল ও পর্যালোচনা নিম্মে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করা হল :
ঐ গবেষনাটি করা হয়েছিল “কচুরিপানা” র মত একটি পরিবেশগত উপদ্রবকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পাকৃতিক সম্পদ তথা মানুষের খাদ্য হিসাবে রুপান্তিরিত করার উদ্যোগ। গবেষনায় কচুরিপানার পাতা সর্বাধিক প্রেটিন সমৃদ্ধ পাওয়া গিয়েছে।
কচুরিপানার পাতার প্রোটিন সমৃদ্ধ (Water Hyacinth leaf protein Concentrate – WHLPC) এ্যানালাইসিসে প্রোটিন তার পূষ্টির ৫০%, কার্বোহাইড্রেট ৩৩% পাওয়া গিয়েছে। পুষ্টির বাকী ১৭% হল ফ্যাট, ছাই এবং ফাইবার।
এ্যামিনো এসিড বিশ্লেষনে WHLPC তে ২০টি সাধারন এ্যামিনো এসিডের মধ্যে ১৭ টির উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে , বিশেষত Phe (3.69%), Leu (5.01%) পাওয়া গিয়েছে।
মোট ক্ষারক এবং ফেলিক যৌথ গুলির স্তর যথাক্রমে ১৬.৬ মিলিগ্রাম / কেজি এবং ৬.০ মিলি গ্রাম/কেজি পাওয়া গিয়েছে। এছাড়াও হেভি মেটাল এর অ্যানালাইসিস এ WHLPC কে মানব স্বাস্থের জন্য নিরাপদ পাওয়া গিয়েছে।
গবেষনায় প্রাপ্ত ফলাফল প্রদর্শণ করা হল:
পুষ্টি (Nutrient ) | ঘনত্ব (Concentration) |
ক্রড প্রোটিন (Crude Protein) | ৫৬.৩৮± ২.১৫ |
ফ্যাট (Fat) | ৪.১১ ± ০.৫৫ |
আঁশ (Ash) | ৪.৮৮±০.২৮ |
ক্রড ফাইবার (Crude Fiver) | ১.০২±০.০৫ |
কার্বোহাইড্রেট (Carbohydrate) | ৩৩.৬১±১.৫৫ |
এ্যামিনো এসিড এ্যানালাইসিস :
এ্যামিনো এসিড (Amino Acid) | ঘনত্ব (Concentration)% | FAO Standard |
এ্যালানি ( Alanine ) | ৩.২০±০.১৫ | গ্রাম/১০০ গ্রাম |
আরজেনাইন (Arginine) | ৩.৮০±০.২৩ | প্রয়োজনীয় নয় |
অ্যাসপারটিক এসিড (Aspartic Acid) | ৪.৯৬±০.২৫ | প্রয়োজনীয় নয় |
সিসটনাইন (Cysteine) | ০.৭২±০.০১ | প্রয়োজনীয় নয় |
গুলাটামিক এ্যাসিড (Glutamic acid | ৬.০৪±০.৫২ | প্রয়োজনীয় নয় |
গ্লাইসিন (Glycine) | ৩.০০±০.১২ | প্রয়োজনীয় নয় |
হিসটিডাইন (Histidine) | ১.১০±০.০৯ | প্রয়োজনীয় নয় |
আইসোলিউসাইন (Isoleucine) | ২.২৯±০.৩২ | ৪.২ |
লিউসাইন (Leucine) | ৫.০১±০.৩৫ | ৪.৮ |
লোইসিন (Lysine) | ৩.৭২±০.৪৮ | ৪.২ |
মেথিওনাইন (Methionine) | ১.৩৪±০.0৮ | ২.২ |
ফেনিলালাইন (Phenylalanine) | ৩.৬৭±০.২২ | ২.৮ |
প্রোলাইন (Proline) | ২.৭২±০.১১ | প্রয়োজনীয় নয় |
সেরিণ (Serine) | ২.৫২±০.১৫ | প্রয়োজনীয় নয় |
থিওনিন (Threonine) | ২.৬০±০.১৭ | ২.৮০ |
টাইরোসিন (Tyrosine) | ২.২০±০.১৩ | ২.৮০ |
ভেলিন (Valine) | ২.৮১±০.১১ | ৪.২ |
হেভিমেটাল অ্যানালাইসস :
হেভিমেটাল | ঘনত্ব (Concentration) (মিলিগ্রাম/কেজি) | Upper limit (মিলিগ্রাম/কেজি) |
ক্রেডমিয়াম (Cd) | ০.০২±০.০০১ | ০.০৫ |
ক্রুমিয়াম (Cr) | ০.১৩±০.০০১ | ১.০ |
লীড (Pb) | ০.০০১±০.০০ | ০.১ |
ফ্লাটিনাম (Pt) | ০.০০১±০.০০ | ০.১ |
ক্যাডমিয়াম (Pd) | ০.০০৩±০.০০১ | ০.১ |
টিন (Sn) | ০.০০১±০.০০ | ০.১ |
পারদ (Hg) | ০.০২±০.০০১ | ০.০৫ |
লোহা (Fe) | ০.০০১±০.০০ | ৫.০ |
ম্যাঙ্গানিজ (Mn) | ০.০০১±০.০০ | ০.০৫ |
কপার (Cu) | ০.০০১±০.০০ | ৫.০ |
জিংক (Zn) | ০.০০১±০.০০ | ২৪.০ |
নিকেল (Ni) | .০০১±০.০০ | ০.৫ |
উল্লেখ্য যে বহু ক্ষেত্রে জলাশয়ের পানি হতে হেভিমেটাল অপসারনের জন্য কচুরিপানার চাষ করা হলেও ঐ সকল হেভি মেটাল কচুরিপানার পাতা বা ফুলে আসে না বলে গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, গত ১৭ ফেব্রুয়ারী তারিখ মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী মহোদয় এনইসি – ২ সম্মেলন কক্ষে গবেষকদের উদ্দেশ্যে কচুরিপানা মানুষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা যায় কিনা – সে উপদেশ প্রদান করেছিলেন। সে একই সম্মেলনে তিনি কাঁঠালের আকার বড় ও উপরের ত্বক মসৃন ও সুন্দর করা যায় কিনা সে বিষয়েও গবেষকদেরকে পরামর্শ প্রদান করেন।
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কোন একটা প্রানীর খাদ্য হিসাবে কচুরিপানার ব্যবহারের সাথে তুলনা করে গবেষকদের মাঝে উদ্দীপনা ও আগ্রহ সৃষ্টির জন্যই হয়ত বলতে চেয়েছেন যা অন্য প্রানীর খাদ্য হিসাবে নিরাপদ তা মানুষের জন্যও নিরাপদ হতে পারে।
কিন্তু মন্ত্রী মহোদয়ের তুলনা করা প্রানীটি নাম গরু হওয়াতেই যতসব বিপত্তি। প্রত্রিকায় ব্যঙ্গত্বক হেডলাইনে খবর, ইউটিউব, ফেসবুক প্রভৃতি সামাজিক মাধ্যমে ব্যঙ্গত্বক উপস্থাপন, ভিডিও প্রচার করা হয়েছে।
মাননীয় পরিকল্পনা মন্ত্রী মহোদয়ের নির্দেশণাকে মহান জাতীয় সংসদে কোন কোন মাননীয় সংসদ সদস্য নেগেটিভ ভাবে বক্তবে উপস্থাপন করেছে। (সাম্প্রতিক দেশকাল, তারিখ; ২২/০২/২০)।
ইহা শুধু মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়কে হেয় প্রতিপন্ন করেছে তাই নয়, ইহা আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য বিকল্প খাদ্যের উৎস অন্বেষণকেও হেয় প্রতিপন্ন করেছে, গবেষকদের মধ্যে মারাত্বক নিরুৎসাহ সৃষ্টির কারণ ঘটিয়েছে। গবেষণায় কচুরিপানা বিকল্প খাদ্য হিসাবে স্বীকৃত হলেও এ যে ব্যঙ্গত্বক প্রচার তা ভবিষ্যতে খাদ্য হিসাবে ব্যবহারেও মানুষের মধ্যে অনুৎসাহ যোগাবে।
Worldometer এর তথ্য মতে এখন পৃথিবীর জনসংখ্যা ৭.৭৯ বিলিয়ন, ২০০০ সালে ছিল ৬.১৪ বিলিয়ন এবং ২০৫০ সালে দাড়াবে ৯.৭৪ বিলিয়ন। বিজ্ঞানীদের মহা চিন্তার বিষয় হল পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এতসব মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, আবাস্থল, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার যোগানের জন্য বন- জঙ্গল, পাহাড়-পর্বত উজাড়, নদ-নদী, জলভূমি, সমুদ্র ভরাট, দখল হয়ে যাচ্ছে।
সাথে সাথে পরিবেশের উপরওে মারাত্বক প্রভাব ফেলেছে এবং বিপর্যয় ঘটাচ্ছে তারপরও এক সময় এ সকল প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস নিঃশেষ হয়ে যাবে। তখন জনসংখ্যার বৃদ্ধির হারের সাথে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সক্ষমতা থাকবে না, থমকে যাবে। তাইতো SDG এর ১৭টি লক্ষ্যের ২নং লক্ষ্যই হল “ক্ষুধা হতে মুক্তি (SDG 2: No Hungry)
এখনও আমরা এ পৃথিবীকে ক্ষুধা মুক্ত করতে পারিনি এবং ভবিষ্যতে মানুষ এবং খাদ্য সরবরাহ / উৎপাদনের মধ্যে যে, এক বিস্ময়কর ফারাক সৃষ্টি হবে সে অবস্থায় এ পৃথিবীতে মানুষ এবং খাদ্য সরবরাহের মধ্যে কিভাবে সমন্বয় করা হবে – সে রকম কাহিনী নিয়েই হলউিডে Sci-fi Logan’s Run নামে বিজ্ঞান কল্প কাহিনী ভিত্তিক সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে।
আমরা মাত্র এখন একবিংশ শতাব্দির একাবারে এক-চর্তুথাংশরে মধ্যেই রয়েছি Sci-fi Logan’s Run সিনেমাটিতে ২৩০০ শতাব্দিতে যখন বিশ্বে জনসংখ্যার তুলনায় খাদ্য উৎপাদন কমে যাবে, তখন ইউটোপিয় সমাজ ব্যবস্থায় খাদ্য ও মানুষরে মধ্যে সমন্বয় করার জন্য একটি নিয়ম চালুর বিষয়টি দেখানো হয়েছে, যেখানে কোন নাগরিকের বয়স ৩০ বছর হওয়া মাত্রই তাকে গুলি করে হত্যা করা।
আমরা কেহ নিশ্চই চাইনা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা এমন এক কঠিন সমস্যার মুখোমুখী হউক। তাইতো পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান মানুষের খাদ্য চাহিদা মিটানার জন্য দেশে দেশে পরিবেশ সম্মত বিকল্প খাদ্যের উৎস অন্বেষণে বিজ্ঞানীরা অবিরাম ভাবে গবেষণা করে যাচ্ছে।
ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য সংস্থানের জন্য বিশ্বব্যাপী গবেষকদের এখন ঘুম নাই। প্রতিনয়তই গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। এ পৃথিবীর সাধারন প্রাকৃতিক খাদ্যের উৎস নিকট ভবিষ্যতেই ফুরিয়ে যাবে এবং বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃষি উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি জনসংখ্যার বৃদ্ধির তুলনায় পিছিয়ে পড়বে।
সে পরিস্থিতিতে ভবিষ্যত প্রজন্মের খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বিকল্প খাদ্য উৎসের সন্ধানে গবেষকদের চেষ্টার কোন কমতি নাই। পৃথিবী জুড়ে বিকল্প খাদ্যের উৎস অবিরাম ভাবে খোঁজা হচ্ছে।
প্রসংগত উল্লেখ্য যে, পৃথিবী যে ক্রমাগতভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তা মূলত: গ্রীণ হাউজ গ্যাসের জন্যই হচ্ছে, আর মিথেন হল গ্রীণহাউজ গ্যাসসমূহের মধ্যে ৩য় শক্তিশালী গ্যাস যা CO2 অপেক্ষা 25 গুন শক্তিশালী।
আর মিথেন নির্গত হওয়ার বড় একটি কারণ মানব জাতির পুটিন, স্বেতসার, চর্বি, ভিটামিন, শর্করা ইত্যাদি চাহিদা মিটানোর জন্য পশু পালন তথা গরু, ছাগল, হাঁস মুরগী পালন করতে হচ্ছে। আর এসব পশুর গোবর ও প্রস্রাব হতেই মূলত: মিথেন গ্যাস নির্গত হচ্ছে। বিশ্বের জনসংখ্যার যতই বৃদ্ধি ঘটছে, পশু পালনও ততই বেড়ে যাচ্ছে।
তাই পশুর মাংস, ডিম ও দুধের বিকল্প হিসাবে সামুদ্রিক শ্যাওলা ব্যবহারে মানব জাতির জন্য আমেরিকা ইউরোপসহ নানা দেশে নানা রকম গবেষনা চলছে। তারমধ্যে ইস্রাইল ও নেদারল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের গবেষণা ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
আমাদের দেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব অত্যধিক এবং বৃদ্ধির হারও অনেক বেশী। তাই ছোট দেশে এ বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য যোগানে এখনই আমাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে, পৃথিবীর অন্যদেশগুলোর তুলনায় ভবিষ্যতে যে এত বিশাল জনসংখ্যার খাদ্য যোগানে আমাদের দেশকে বিষম সংকটের মূখোমূখি হতে হবে – তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বিকল্প খাদ্যের উৎস খোজার জন্য জোর গবেষণার অত্যন্ত জরুরী।