অস্ট্রেলিয়া, আপনাদের দেশ জ্বলে যাচ্ছে- বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন এখন আপনাদের সাথে – মাইকেল ম্যান
অনুবাদ : সাদিয়া নূন পর্সিয়া ও রহমান মাহফুজ
টিকা: রহমান মাহফুজ
আমি একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী, আপানাদের নীল পর্বতমালায় ছুটিতে এসে জলবায়ু পরিবর্তনের কার্যকলাপ দেখছি।
বহু বছর ধরে জলবায়ু অধ্যয়ন করার পর, আমার কাজ আমাকে সিডনিতে নিয়ে এসেছে যেখানে আমি জলবায়ু পরিবর্তণ এবং চরম আবহাওয়ার বিষয়ের সম্পর্ক নিয়ে অধ্যয়ন করছি।
সিডনিতে আমার বিশ্রামকালীন অবস্থান করার আগে, আমি আমার পরিবারের সাথে অস্ট্রেলিয়ায় অবকাশ যাপনের জন্য এ ছুটির মৌসুমের সুযোগটি গ্রহণ করেছি। আমরা অস্ট্রেলিয়ার কুন্সল্রান্ডের কোরাল সমুদ্রের বৃহৎ প্রবাল-প্রাচীর(Great Barrier Reef১) দেখতে গিয়েছিলাম – যা এ গ্রহের এক বিশাল আশ্চর্য – যা আমরা এখনও দেখতে পারি। উষ্ণায়নের ফলে সৃষ্ট ব্লিচিং(Bleaching২) এবং সমুদ্রের অম্লীকরণ (Sea Acidification৩) – এ দুটি কারণে যা বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ র্বদ্ধির ফলে আগামী কয়েক দশকের মধ্যে এটি ধংস হয়ে যাবে।
আমরা অস্ট্রেলিয়ার অপর প্রাকৃতিক বিস্ময়, নীল পর্বতমালায়ও ঘুরেছি, যা উষ্ণ ঘন বর্ষণবনাঞ্চল (Temperature rainforest), জাঁকঝমকপূর্ণ পর্বত শ্রেণীমালা (majestic cliffs) এবং পাথুরে শিলা বিন্যাস ও সুদূরপ্রসারী দৃষ্টি নন্দন দৃশ্য(panoramic vistas)অবলোকনের জন্য পরিচিত এবং যা বিশ্বের অন্য যে কোনও মনোরম স্থানকে চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম। এটিও এখন জলবায়ু পরিবর্তনের দ্বারা হুমকির মধ্যে রয়েছে। আমি এটি সরাসরিভাবে প্রত্যক্ষ করেছি।
দূরবর্তী নীল রঙের পর্বতমালার পরিসর দ্বারা গঠিত ঘনবর্ষণ বনাঞ্চলের বিশাল বিস্তৃতি আমার দৃষ্টি সীমার বাহিরে ছিল। তার পরিবর্তে, আমি ধোঁয়া ভর্তি উপত্যকাগুলির সন্ধান পাইলাম, দূরবর্তীতে যে গুলোর পেছনের ঢাল ও চূঁড়া মরা ভূতের পটভূমিতে দেখাচ্ছিল। আদর্শ নীল আভা (যা ইউক্যালিপ্টাস গাছ নির্গত “তারপিন” এর বাষ্প থেকে আহরণ করা হয় যেগুলি এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়) একটি বাদামি আবছায়া দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। নীল আকাশও সেই বাদামি কুয়াশা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।
স্থানীয়রা, যাদের আমি বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে এবং আমাকে বহির্গামী বলে মনে করেছে , তারা নিজে থেকে বললো যে তারা এর আগে কখনও এমন কিছু দেখেনি। কেউ কেউ অবিলম্বে “জলবায়ু পরিবর্তন” শব্দটিও উচ্চারণ করেছিলেন।
কয়েক দশক আগে আমার প্রথম উপভোগ করা পিটার গ্যারেট এবং মিডনাইট অয়েল (Peter Robert Garrett and Midnight Oil৪) গানগুলি এখন আমার কাছে একেবারে নতুন অর্থ মনে হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ায় আমার নিকট প্রকাশিত হওয়া যা আমি প্রত্যক্ষ দর্শন করছি তার আলোকে এ গানগুলিকে অস্থিরভাবে দূরদর্শী বলে মনে হচ্ছে।
এ সপ্তাহে আমি নীল পর্বতমালায় যে বাদামী আকাশটি লক্ষ্য করেছি তা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ফল। উষ্ণায়ণের লিখিত বিবরণী নিয়ে শুষ্ক অঞ্চলসমূহে বর্তমানে চলামান চরম খরার সাথে মিলালে দেখা যাবে যে, নীল পর্বতমালাকে ঘিরে এবং অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়া অভূতপূর্ব বুশফায়ার এটি। ইহা বুঝতে জটিল কোন কিছু নয়।

আমাদের গ্রহের উষ্ণায়ন এবং এর সাথে সম্পর্কিত জলবায়ুর পরিবর্তনগুলি, আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানী (খনিজ তেল যেমন ডিজেল, অকটেন, মবিল ইত্যাদি) পোড়ানোর কারণেই ঘটছে। তেল, মধ্যরাতে বা দিনের যেকোনো সময় পোড়ানো হোক না কেন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং সর্বোপরি সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর, কয়লা – এগুলোর জন্যই জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। এটি স্পষ্ট এবং বুঝতে জটিল কিছু নয়।
যখন আমরা কয়লার জন্য খনি খনন করি, বিতর্কিতভাবে পরিকল্পিত আডনি কয়লাখনি ( Adani coalmine৫) এর মতো, যা থেকে কার্বণ নিঃসরণের পরিমাণ হবে অস্ট্রেলিয়ার কয়লাভিত্তিক মোট কার্বন নিঃসরণের দ্বিগুণেরও বেশি , তার মানে আমরা আক্ষরিক অর্থে আমাদের নীল আকাশকে খনন করে যাচ্ছি। আডনি কয়লা খনিটির যথাযথ নামকরণ করা যেতে পারে নীল আকাশ খনি।
অস্ট্রেলিয়ার বিছানা জ্বলছে। জ্বলছে পুরো শহর, অপূরণীয় বন এবং বিপন্ন ও মূল্যবান প্রাণী প্রজাতি যেমন কোয়ালা (সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র জীবিত প্লাস্টিক খেলনা) অভূতপূর্ব বুশফায়ারের কারণে বিশাল সংখ্যায় ধ্বংস হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়া মহাদেশটি রূপকভাবে এবং কিছু অর্থে আক্ষরিকভাবে জ্বলছে।
তবুও প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন অস্ট্রেলিয়া যে জলবায়ু জরুরি অবস্থায় ভুগছে সে সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য ভাবে উদাসীন, তিনি হাওয়াইয়ে অবকাশ যাপনকে বেছে নিয়েছেন যখন অস্ট্রেলিয়ানরা অভূতপূর্ব উত্তাপ ও বুশফায়ার নিয়ে তর্কবিতর্ক করছিল।
মরিসন দেখিয়েছেন তিনি কয়লার স্বার্থে কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ এবং তার প্রশাসন মাদ্রিদে সাম্প্রতিক জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (COP25)” এ তার বীরুদ্ধে অল্প সংখ্যক পেট্রোস্টেটের( Petro states৬ ) ষড়যন্ত্রমূলক নাশকতা বলে মনে করেছিল । COP25, যা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড এর নীচে বজায় রাখার সর্বশেষ প্রচেষ্টা হিসাবে দেখা হয়, যার বেশী উষ্ণতার বৃদ্ধি ঘটলে পৃথিবীর উষ্ণায়ন “বিপজ্জনক” অবস্থায় উপণীত হবে বলে অনেকের দ্বারা বিবেচিত।
তবে অস্ট্রেলিয়ানদের প্রয়োজন কেবল সকালে ঘুম থেকে ওঠা, টেলিভিশন চালু করা, সংবাদপত্র পড়া অথবা জানালা খুলে বাহিরে দেখার জন্য কিছু সন্ধান করা- অনেকের কাছেই বিষয়টি এরকম। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার জন্য, বিপজ্জনক জলবায়ু পরিবর্তন ইতোমধ্যে চলে এসেছে। এটি কেবল একটি বিষয় যে আমরা এটাকে আর কতটা খারাপ হতে দিতে ইচ্ছুক।
Pump Station 9 Fire, Williamtown NSW Australia from Media Response Newcastle on Vimeo.
অস্ট্রেলিয়া একটি জলবায়ু জরুরী অবস্থা অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। এটি আক্ষরিকভাবে জ্বলছে। এটির এমন একটি নেতৃত্বের প্রয়োজন যে এ সমস্যাটি বুঝবে এবং কাজ করবে এবং প্রয়োজন ভোটারদের দ্বারা রাজনীতিবিদদের ভোটবাক্স সম্পর্কে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য করা।
অস্ট্রেলিয়ানদের অবশ্যই জীবাশ্ম জ্বালানী রাজনীতিবিদদের ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে যারা সমস্যার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছেন এবং জলবাযু রক্ষকদের ভোট দিতে হবে যারা এটি সমাধান করতে ইচ্ছুক।

মাইকেল ই ম্যান পেনসিলভেনিয়া স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানের বিশিষ্ট অধ্যাপক। টম টোলেসের সাথে তাঁর সর্বাধিক সাম্প্রতিক বইটি হল ম্যাডহাউস এফেক্ট: কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তন অগ্রাহ্যতা আমাদের গ্রহকে হুমকী দিচ্ছে, আমাদের রাজনীতি ধ্বংস করছে এবং আমাদের পাগল করে দিচ্ছে (কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদমাধ্যম, ২০১৬) ।
টিকা:
১. অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড উপকূলে কোরাল সাগরে অবস্থিত দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফটি বিশ্বের বৃহত্তম প্রবাল প্রাচীর যার আয়তন প্রায় ৩৪৪,৪০০ বর্গ কিলোমিটার। প্রায় ২,৩০০ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে ২,৯০০ টি পৃথক রেফ এবং ৯০০ টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত।

২. কোরাল ব্লিচিং হল প্রবাল পলিপগুলির টিস্যুর অভ্যন্তরে থাকা শেত্তলাগুলি বের হয়ে যাওয়া। ইহাতে প্রবাল সাদা হয়ে যায় এবং মৃত্যু ঘটে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের পানি গরম হওয়ার কারণে এমনটি

৩. মহাসাগর অম্লীকরণ হ’ল বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড বৃষ্টির পানির সাহায্যে সমুদ্রের পানিতে মিশে পানির PH মান এর হ্রাস ঘটায়। কার্বন ডাই অক্সাইড বৃস্টির পানির সাথে বিক্রিয়া করে র্কানিক এসিড উৎপন্ন করে যখন সমুদ্রের পানিতে পড়ে তখন সামুদ্রিক লবন ক্যালসিয়াম এর সাথে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ক্যালসিয়াম কার্বনেট (CaCO3) তলানি তৈরী করে যা বহু সামুদ্রিক প্রানির দেহের উপর সেল (shells)গঠন করে। ক্যালসিয়াম কার্বনেট তলানি যখন জীবন্ত প্রবালের উপর পড়ে সেল তৈরী করে তখন প্রবাল মারা যায়। বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইড এর পরিমান যত বেশী বৃদ্ধি পাবে তত বেশী প্রবাল মারা যাবে।
CO2 (air) + H2O (rain water) – H2CO3 (acid)
H2CO3 + Ca+2 – CaCO3 (Calcium Carbonate – compound) + H–

৪.পিটার রবার্ট গ্যারেট একজন অস্ট্রেলিয়ান সংগীতশিল্পী, পরিবেশবাদী, কর্মী এবং প্রাক্তন রাজনীতিবিদ। গ্যারেট হলেন অস্ট্রেলিয়ান রক ব্যান্ড মিডনাইট অয়েল এর প্রধান গায়ক।
৫. কারমাইকেল কয়লা খনি অস্ট্রেলিয়ার মধ্য কুইন্সল্যান্ডের গ্যালিলি অববাহিকার উত্তরে একটি অনুমোদিত তাপ কয়লা খনি। উক্ত খনির কয়লা উত্তোলনের জন্য খনন উন্মুক্ত এবং ভূগর্ভস্থ উভয় পদ্ধতিতে করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। খনিটির প্রস্তাব ভারতের আদানি গ্রুপের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন আদানি মাইনিং দ্বারা প্রস্তাবিত।

৬. পেট্রোস্টেট: তেল সমৃদ্ধ একটি ছোট দেশ যেখানে প্রতিষ্ঠানগুলি দুর্বল এবং সম্পদ ও শক্তি কয়েকজনের হাতে কেন্দ্রীভূত। এমন একটি রাষ্ট্র যার সম্পদ তেল বিক্রি থেকে শুরু হয়। পেট্রোস্টেট হিসাবে প্রায়শই বর্ণিত দেশগুলির মধ্যে রয়েছে আলজেরিয়া, ক্যামেরুন, চাদ, ইকুয়েডর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, লিবিয়া, মেক্সিকো, নাইজেরিয়া, ওমান, কাতার, রাশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ভেনেজুয়েলা ।
Source: The Guardian And Wikipidia