পরিবেশ রক্ষায় জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি: রিজওয়ানা হাসান
ঢাকার নদীগুলোকে পুনজ্জীবিত করার বিষয়ে আয়োজিত এক নীতি সংলাপে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, “পরিবেশ রক্ষায় জাতি হিসেবে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।” তিনি বলেন, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের অগ্রাধিকার প্রকৃতিকেন্দ্রিক বা প্রকৃতিবান্ধব হয়নি।
বাংলাদেশের নদীগুলো ঘিরে সংকটের কথা উল্লেখ করে উপদেষ্টা বলেন, “নদীগুলো মূলত জৈবিকভাবে মৃত। যখন ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবেশগত কার্যক্ষমতার র্যাংক ১৭৯, তখন সেটাকে ৫০ পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। ১৭৯ থেকে ৫০, ৬০ বা ৭০-এ যাওয়া আসলেই খুব কঠিন। কিন্তু একবার আপনি এটিকে ৭০ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলে, সেখান থেকে দ্রুত অগ্রসর হওয়া সম্ভব। আমরা এখন ১৭৯-এ আছি, এটা দেখায়, আমরা ব্যর্থ হয়েছি, একটি জাতি হিসেবে সমষ্টিগতভাবে।”
‘রিভাইভিং ঢাকা’স রিভার্স: পলিসি অপশনস ফর সাসটেইনেবল ম্যানেজমেন্ট শীর্ষক নীতি সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। আজ সোমবার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি (এনএসইউ)-এর সিন্ডিকেট হলে আয়োজিত এ সংলাপের আয়োজন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব পলিসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্স (এসআইপিজি)।
উন্নয়ন চিন্তায় মৌলিক পরিবর্তন আনার ওপর জোর দেন পরিবেশ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, “আমরা ইকোসিস্টেম হত্যা করছি। আপনি যা হত্যা করছেন, সেটিকে আপনি জন্ম দিতে পারবেন না। আপনি সেটিকে পুনঃসৃষ্টি করতে পারবেন না। আপনি শত শত ট্যানারি কারখানা বানাতে পারবেন। আপনি আরেকটি বুড়িগঙ্গা তৈরি করতে পারবেন না।”
নদীব্যবস্থা পুনরুদ্ধার দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্ভব নয় বলে রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এক-দেড় বছরের মধ্যে সমাধান খুঁজে পাওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব।” এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংক-এর সঙ্গে সরকারের আলোচনা চলছে বলেও জানান তিনি।
আজকের সংলাপে পরিবেশ উপদেষ্টা নদী রক্ষায় সরকারের কিছু কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে নদী পুনরুদ্ধার কাঠামো প্রণয়ন; নদীর তলদেশ পরিষ্কার করা, দূষক অপসারণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা; নদীর পানি ও পরিবেশের গুণমান নিয়মিত নজরদারি এবং মানোন্নয়ন এবং পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করা। পাশাপাশি ভারত এবং নেপাল এর নদী পুনরুদ্ধারে উদাহরণ দিয়ে নদী এবং পরিবেশ রক্ষায় রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিশ্চিতের আহ্বান জানান তিনি।
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন একেবারেই জরুরি কি না, এমন প্রশ্ন তুলে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এগুলো রাজনৈতিক নেতাদের তৈরি করা হাইপ এবং আমরা শুধু শিখেছি সেই হাইপের বিপরীতে ডেলিভার করতে, যা তারা তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক স্বার্থে তৈরি করেছে।” এর ফলে প্রাকৃতিক বন এবং হাতির করিডর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, নদী রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকতে হবে। তিনি বলেন, দূষণের উৎস বন্ধ করা গেলে ঢাকার নদীগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
ঢাকার দূষণের মূল উৎস মূলত গাজীপুর এবং সাভার। মূল উৎসকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা করতে হবে। গাজীপুরকে মাথায় না রেখে পরিকল্পনা করা হলে এটি হবে অর্থের অপচয় এবং এটাই হয়ে চলেছে।
সংলাপে নদীদূষণ নিয়ে ‘ইন্টিগ্রেটেড রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট অব হেভি মেটাল পলিউশন ইন ঢাকা’স রিভার ওয়াটার্স ফর সাসটেইনেবল রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক একটি গবেষণার কিছু তথ্য তুলে ধরা হয়। গবেষণাটি এখনো চলছে।
গবেষণায় অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন এবং অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এর ফলে ঢাকার প্রধান নদীগুলোর পানি ও পলি দূষণের উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। বলা হয়, রাজধানীর নদীগুলো বিষাক্ত ভারী ধাতু দিয়ে ব্যাপক মাত্রায় দূষিত।
এসব নদীতে ক্যাডমিয়াম, সিসা, আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, নিকেল ও তামার উপস্থিতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নিরাপদ মাত্রাকে ছাড়িয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুম বিশেষ করে শীতকালে এ দূষণের মাত্রা আরও বেশি থাকে।
দূষণের এমন গুরুতর মাত্রা জলজ প্রাণী এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে। দূষণজনিত মৃত্যু ও অসুস্থতার ফলে বছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৭৫ লাখ মার্কিন ডলার।
সংলাপে নদীদূষণ নিয়ে একটি নিবন্ধ তুলে ধরা হয়। তাতে রাজধানীর নদীদূষণের কারণ, প্রতিকারসহ নানা বিষয় তুলে ধরা হয়।
দূষণরোধে বাধ্যতামূলক তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার (ইটিপিএস), এবং গ্রিন ট্যারিফসহ জরুরি নীতিগত হস্তক্ষেপের প্রস্তাব করা হয়।
আজকের সংলাপে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল হান্নান চৌধুরী সভাপতিত্ব করেন। এসআইপিজির পরিচালক অধ্যাপক শেখ তৌফিক এম হক এর সঞ্চালনায় সংলাপে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ, বিআইডব্লিউটিএ-এর চেয়ারম্যান কমোডর আরিফ আহমেদ মোস্তফা প্রমুখ।