বৈশ্বিক উষ্ণায়ন
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হলো গ্রিনহাউস ইফেক্টর ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি। বৈশ্বিক পৃথিবীর পরিবেশে গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির যেমন কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, জলীয় বাস্প ইত্যাদি) বৃদ্ধির ফলে গ্লোবাল তাপমাত্রার বৃদ্ধি। এই প্রক্রিয়া পৃথিবীর সিস্টেমের মধ্যে উষ্ণতা বৃদ্ধি করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
গ্রীনহাউজ ইফেক্ট হলো শীতপ্রধান দেশে সবজী উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্রীনহাউজ বা সবুজ ঘরের মত প্রাকৃতিকভাবে ঘটে যাওয়া একটি প্রক্রিয়া যা ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমন্ডলকে উত্তপ্ত করতে সহায়তা করে।
সহজভাবে বললে- পৃথিবীটিকে যদি আমরা একটি শস্য ক্ষেত্রের সাথে তুলনা করি তবে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ১০-১৫ কিঃমিঃ উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত কতকগুলো গ্যাস (জলীয় বাষ্প, মিথেন, কার্বণ ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি গ্যাস)পৃথিবীটিকে স্বচ্ছ কাঁচের দেওয়ালের মত স্তরে স্তরে ঘিরে অবস্থান করছে যা গ্রীনহাউজ বা সবুজ ঘরের সাথে তুলনীয়।
সূর্য হতে আসা আলোক রশ্মি দ্বারা ভূ-পৃষ্ঠে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা এ সকল গ্যাস মহাশূণ্যে বিকরণে বাঁধার সৃষ্টি করে এবং পূণ:পূণিকভাবে প্রতিফলন করে ভূ-পৃষ্ঠকে উত্তপ্ত করে-এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় গ্রীনহাউজ ইফেক্ট আর এই গ্যাসগুলোকে বলা হয় গ্রীনহাউজ গ্যাস।
গ্রীনহাউজ গ্যাসগুলি হলো প্রধানতঃ জলীয় বাষ্প (H2O vapor), কার্বনডাইঅক্সাইড (CO2), মিথেন (CH4), নাইট্রাস অক্সাইড (N2O), ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন ওজোন (Ground level O3), ক্লোরোফ্লোরো কার্বন (CFCl3)।
বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বাড়ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা এভাবে বেড়ে যাওয়া্ই হলো বৈশ্বিক উষ্ণায়ন।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণ:
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রধান কারণ হল বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি, যা মূলত মানুষের কার্যকলাপের কারণে হয়ে থাকে।
সূর্য থেকে ভূ-পৃষ্ঠে আসা উচ্চ শক্তির আলোক রশ্মি বাযুমন্ডল ভেদ করে কয়েকটি প্রক্রিয়ায় ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছায়। আলোক রশ্মি কায়ু মন্ডল ভেদ করার সময় ৪৬% মেঘ ও গ্যাস দ্বারা শোষিত হয় এবং মহাশূণ্যে প্রতিফলিত ও বায়ুমন্ডল দ্বারা মহাশূণ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
ফলে কিছু শক্তি ক্ষয় হয়ে ৫৪% ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছায়। ভূ-পৃষ্ঠে আসা আলোক রশ্মির ৪৯% ভূ-পৃষ্ঠ দ্বারা শোষিত হয় এবং ৫% বায়ুমন্ডলে কম শক্তিতে প্রতিফলিত হয়।
ভু-পৃষ্ঠ দ্বারা শোষিত আলোক রশ্মি পৃথিবীরে পৃষ্টকে উত্তপ্ত করে পরবর্তীতে বাযুমন্ডলে প্রতিফলিত হয় অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠে আসা উচ্চ শক্তির (Sort wave) ৫৫%ই বাযুমন্ডলের এ কম শক্তির (Long wave) বিকিরণ রূপে প্রতিফলিত হয়।
প্রতিফলিত এ কম শক্তির বিকিরণ গ্রীনহাউজ গ্যাসসমূহ দ্বারা সৌর মন্ডলে ফেরত যেতে বাঁধা প্রাপ্ত হয় এবং উক্ত গ্যাসসমূহ দ্বারা শোষিত হয়।
শোষিত বিকিরণ তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে এবং বায়ুমন্ডলে প্রতিফলিত ফতিপ্রলিত হয়ে এবং ভূ-পৃষ্ঠে পূনঃপূনঃ শোষিত হয়ে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে।
বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাসের যত বৃদ্ধি ঘটছে ভূ-পৃষ্ঠ দ্বারা প্রতিফলিত কম শক্তির বিকিরণ ততই পূনঃপূনঃ প্রতিফলিত ও শোষিত হয়ে বায়ুমন্ডলের তথা ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যুগপৎ বৃদ্ধি করে চলেছে।
মানুষের কর্মকান্ডের ফলে বিশেষ করে ১৭৫০ সালের শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বাযুমন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাসের পরিমান দ্রুততর ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
শিল্প কারখানায়, পরিবহন -যোগাযোগ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানী হিসাবে জীবাস্ম জ্বালানী (Fossil Fuel) যেমন প্রেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, লুব্রিক্যান্ট, কয়লা, গ্যাস ইত্যাদির ব্যবহারে গ্রীণহাউজ গ্যাস গুলি উৎপন্ন হয়।
এ ছাড়া কৃষি কাজ, খোলা আকাশের নীচে পৃহস্থালী রান্না বান্নায় জ্বালানী হিসাবে খড়-কুটা, কাঠ ইত্যাদি জ্বালানী হিসাবে ব্যবহারে ও প্লাষ্টিক দূষনে এবং পশুপালনে গ্রীণহাউজ গ্যাস গুলি উৎপন্ন হয়। এছাড়া বৃক্ষ নিদনের ফলে বায়ু মন্ডলের কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষনের পরিমান হ্রাস পাচ্ছে।
কারন, গাছ-পাল প্রাকৃতিক ভাবে খাদ্য প্রস্তুতের জন্য বায়ুমন্ডল হতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। বৃক্ষ কর্তনের ফলে এ প্রক্রিয়া ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে।
সভ্যতা বিকাশের নামে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, মানুষের অপরিমিত চাহিদা, অধিক থেকে অধিকতর সুবিধা প্রাপ্তির উচ্চাকাক্সক্ষা ও আরাম প্রিয়তার ফলে ক্রমবর্ধমান ভাবে গ্রীনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধি ঘটে চলেছে।
গ্রীনহাউজ গ্যাসগুলির বায়ু মন্ডলে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ
শিল্প, পরিবহন, স্থান গরম বা শীতলীকরণ যন্ত্রে ব্যবহৃত গ্যাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন, রান্নার জ্বালানী ইত্যাদিতে জীবাশ্ম জ্বালানী (Fossil fuels) যেমন প্রেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, লুব্রিক্যান্ট, কয়লা, গ্যাস ইত্যাদির ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাসগুলো উৎপন্ন হয়।
এছাড়া শীতলকরণ যন্ত্র যেমন ফ্রীজ, এয়ারকন্ডিশনে এবং এরোসোলে ফ্রিয়ন (Freon) গ্যাস হিসাবে ফলে ব্যবহারের ফলে বায়ুমন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাসগুলো উৎপন্ন হয়।
এতদব্যতীত কৃষি কাজ, পশু পালন, পোকামাকড়ের ক্রিয়াকলাপ, বর্জ্য/পচনশীল বস্তু মাটিচাপা দেওয়া, কয়লা, জীবাশ্ম জ্বালানী খনি থেকে উত্তোলন, রান্না, বিদ্যুৎ, সার উৎপাদনে, গাড়ির জ্বালানী হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ব্যবহার এবং এতদ্ব্যতীত, বৃক্ষনিধন ও বন উজাড় করণেও বায়ুমন্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড-এর পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব:
বায়ু মন্ডলে গ্রীনহাউজ গ্যাস যত বৃদ্ধি পাচ্ছে ততই গ্রীনহাউজ ইফেক্ট এর সক্রিয়তাও দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং পৃথিবী নামক এ গ্রহটি ক্রমশঃই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, জ্বলছে আমাদের ঘর আমাদের বাসস্থান, আমাদের পৃথিবী, সাথে সাথে হিমবাহ/বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে নিন্মভুমি, তলিয়ে যাচ্ছে দ্বীপাঞ্চল আর দ্বীপ রাষ্ট্রসমূহ, মানুষের বাসস্থান হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে সাগরের অতল গভীরে।
ইতোমধ্যে র্পূব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, সলোমনদ্বীপূঞ্জের সমূদ্র উপকূলের অনেক নিন্মভূমি ও অনকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ সমূদ্রে তলিয়ে গিয়েছে।
বিশ্বের উষ্ণতা এভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকলে জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের আশংকা বাংলাদেশ ভূখন্ডেরও এক-তৃতীয়াংশ এলাকা যা সমূদ্র উপকূলর্বতী রয়েছে ২১০০ শতাব্দির মধ্যে সমূদ্রে তলিয়ে যাওয়ার আশংকা করছে এবং তখন বাংলাদশেরে ১ হতে ৩ কোটি উপকূলবাসীকে সমূদ্র উপকূলীয় এলাকা হতে অন্যত্র সরাতে হবে।
এছাড়াও তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে, ঋতুর পরবির্তন ঘটছে, শীতের সময় শীত না হয়ে অন্য সময় হচ্ছে এবং কম হচ্ছে, বৃষ্টির সময় বৃষ্টি না হয়ে অন্য সময় হচ্ছে, অল্প সময়ে হঠাৎ অধিক বৃষ্টি হচ্ছে।
এতে অসময়ে বন্যা হয়ে ফসলি মাঠসহ মানুষের জানমাল অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, ঋতুর পরিবর্তনের ফলে কৃষি পঞ্জিকা ঠিক রাখা যাচ্ছে না যা কৃষি উৎপাদনে মারাত্মকভাবে প্রভাব ফেলছে, ইত্যাদি।
এ ছাড়াও জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে বিশ্বে ঘূর্নিঝড়, ভূমি ধ্বস, খরা ও মরুকরন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এগুলির মাত্রা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমুদ্রের লবনক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাপে সমুদ্রের পানি প্রসারিত করছে যা সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি করছে। ফলে লবনাক্ত পারি জোয়ারের কারনে উপকূলিত ফসল উৎপাদনে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জীববৈচিত্র ধ্বংস হচ্ছে। মানবজাতীর রোগব্যধি মারাত্বকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মারাত্বক নতুন নতুন রোগের আর্ভিবাব ঘটছে, ইত্যাদি।
ফলে বর্তমানে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা যে গতিতে বাড়ছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ২০৫০ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা এক বিপর্যয়কর অবস্থায় উপনীত হবে বলে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যৎ বাণী করছেন।
ভূ-পৃষ্ঠের উষ্ণায়ন হ্রাসের উপায়
বৈর্ষিক উষ্ণতা বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশের নয় গোটা বিশ্ব ও মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই পৃথিবীকে জীবজগতের বাসযোগ্য রাখতে হলে অবশ্যই গ্রীনহাউজ গ্যাসসমূহের নিঃসরণ কমাতে হবে, ক্রমান্বয়ে নিঃসরণ শূণ্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে এবং বাযুমন্ডলে নিঃসরিত গ্রীনহাউজ গ্যাসের নিঃসরণ ও নিঃসরিত গ্যাসের পরিমান হ্রাসকরণ প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে।
১) নিঃসরণ হ্রাসকরণে শিল্পকারানায়, পরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাস্ম জ্বালানী (Fosil Fuel) এর ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। তার পরিবর্তে পরিবেশ সহায়ক জ্বালানী তথা নবায়নযোগ্য শক্তি (Renewable Energy) সৌরশক্তি,,বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, বায়োডিজেল, সমূদ্রের তলদেশের জোয়ার-ভাটা শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি যেমন আবর্জনাকেকাজে লাগিয়ে উৎপন্ন শক্তি ও নিউক্লিযারি এনার্জি উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।
২)কৃষিতে রাসয়িক সার এবং কিটনাশক এর ব্যবহার বন্ধ করে তার পরিবর্তে জৈব সার ও প্রার্তিক উপায়ে কীটনাসক ধ্বংস করতে হবে।
৩) খড়কুটা ও শুকানো আগাছা, কাঠ ইত্যাদি খোলা আকাশের নীছে জ্বালানো বন্ধ করতে হবে। রান্নাবান্নায় পরিবেশ সহায়ক জ্বালানীর ব্যবহার বাড়তে হবে।
৫) কৃষি হতে উৎপন্ন উছ্ছিষ্ট, গাছপালার পচন রোধ করতে হবে এবং পশুপালন সীমিত করতে হবে ইত্যাদি।
নিঃসরিত গ্যাস হ্রাসে গাছপালা কর্তন ও বন উজাড় বন্ধ করতে হবে এবং বৃক্ষ রোপন ও নতুন নতুন বনায়ন সৃষ্টির উদ্যেগ নিতে হবে। এছাড়াও কৃত্রিম উপায়ে বায়ুমন্ডলের কার্বন ডাই অক্সাইড শোষনের ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে।
উপসংহার:
এ পৃথিবীকে মানুষ ও সকল প্রাণীর বাসযোগ্য রাখতে গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলোর উ্ৎপাদন হ্রাসের কোন বিকল্প নাই। তাই ধীরে ধীরে গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলোর উ্ৎপাদন হ্রাস করতে হবে এবং একপর্যায়ে উৎপাদন শূণ্যের কোটায় আনতে হবে।